রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫৮:১১

রাজনীতিতে আপ-ডাউন

 রাজনীতিতে আপ-ডাউন

শামীমুল হক : ফাস্টফুডের দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। বাইরে তীব্র গরম। কেউ খাচ্ছেন ঠাণ্ডা পানীয়, কেউ লাচ্ছি। গরম নিবারণের চেষ্টা সবার মাঝে।

এরই মধ্যে দু’যুবক ঢুকলেন ফাস্টের দোকানে। জিজ্ঞাসা করলেন ঠাণ্ডা জাতীয় কি আছে? দোকানি বললেন, আছে অনেক কিছুই। ¯প্রাইট, সেভেনআপ, কোকাকোলা, পেপসি ইত্যাদি।

এক যুবক সেভেনআপ দেয়ার কথা বললো। সঙ্গে সঙ্গে সেভেনআপ দেয়া হলো তাকে। মুখে  দেয়ার আগে দোকানের ম্যানেজারকে জানালো এর নাম সেভেনআপ কেন হলো? ম্যানেজার অনেক চিন্তা করে জানালেন, এটি খেলে সাতবার ওপর দিকে ঢেঁকুর আসে বলে এর নাম সেভেনআপ।

যুবকটি সেভেনআপ খেতে লাগলো আর গুনতে লাগলো কতবার ঢেঁকুর আসল। সেভেনআপ খাচ্ছে আর গুনছে। গুনতে গুনতে ৬ বার দেখা গেল ঢেঁকুর এসেছে। কিন্তু সপ্তমবার ঢেঁকুর না দিয়ে বাতাস ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি ম্যানেজারকে উদ্দেশ করে বলল, এর নাম সেভেনআপ না হয়ে সিক্স আপ ওয়ান ডাউন হওয়া উচিত ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও সারাদেশে চলছে আপ-ডাউন।

শুক্রবার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, সংসদের আগামী অধিবেশনেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা। তিনি বলেছেন, এটিই বিরোধী দলের জন্য শেষ সুযোগ।

অবশ্য আগের দিন প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের জনসভায় বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন। তিনি নৌকায় ভোট দিতে সবার প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। আর সোমবার সচিব সভায় স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন সংবিধান সংশোধন অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর নয়।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে পরবর্তী সরকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত ছোট মন্ত্রিসভা থাকবে। এই মন্ত্রিসভা গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ করবে না।

একেক সময় একেক কথায় একবার মনে হয়, আপে যাচ্ছে সবকিছু। আবার মনে হয় ডাউনে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারে থাকতে নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছে জাতীয় পার্টি।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন করে শরীরে দাগ লাগিয়েছেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। অবশ্য সে নির্বাচন করে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে সংযুক্ত করে তারা বিদায় নেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এবার অনেক নাটকীয় ঘটনার পর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিরোধী দল বিএনপি।

তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। হরতালের পর হরতাল দেয়। কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। সরকারও তার অবস্থানে অনড়। বিরোধী দলও তাদের দাবিতে অনড়। এরই মধ্যে বিরেধী দল ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ঈদের পর কঠোর আন্দোলন। সংসদ নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে। এখনও কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা দেশবাসীর কাছে অজানা।

এরশাদ, খালেদার গায়ে এরই মধ্যে দাগ লেগে গেছে। বাকি রয়েছে শেখ হাসিনার।  মানুষ বলছে, শেখ হাসিনা যদি ৯৬’ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির মতো বিরোধী দলবিহীন একটি নির্বাচন করতে চান, বা করেন তাহলে খালেদার মতো তার শরীরেও একটি দাগ লাগবে। এ দাগ লাগাতে কি তিনি চান? নাকি তার আশপাশের লোকজন কৌশলে তার শরীরে দাগ লাগাতে তৎপর?

বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আওয়ামী লীগকে যারা পছন্দ করেন তারা এটা চান না। তারা চান দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে একটি পথ বের করে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন। তারা চান কলঙ্কমুক্ত থাকুক শেখ হাসিনা।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুতের লোডশেডিং কমেছে এটা সত্য। তবে, কি কারণে বার বার প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচিত হন তা বোধগম্য নয়। ক’দিন আগে বলে বসলেন, আমার নির্দেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। কারণ লোডশেডিং না হলে মানুষ ভুলে যাবে লোডশেডিং কি?
 
এরপর থেকে কেন জানি বিদ্যুৎ বিভাগ একটু বেশিই তৎপর হয়ে ওঠেছে। দ্রুত বদলাতে থাকে চিত্র। ক’দিন ধরে বিদ্যুতের যে বেহাল অবস্থা তাতে শঙ্কিত সবাই। অবস্থা ট্রাফিক পুলিশের হাতের মতো কিনা কে জানে।


ট্রাফিক পুলিশ যেমন প্রকাশ্যে তার হাত দিয়ে গাড়ি আটকে দেয়, আবার হাতের ইশারায় গাড়ি চলতে থাকে ঠিক অপ্রকাশ্যে এমন করে কিনা বিদ্যুৎ বিভাগ- কে জানে। কারণ, বিদ্যুতের চাবিও তো তাদের হাতে।


সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ হাতের কারসাজি চলছে কিনা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
 
সোমবার মতিঝিল থেকে প্রেসক্লাব যাচ্ছিলাম রিকশায় করে। রিকশাচালক বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে একটি বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলো। বার বার নিষেধ সত্ত্বেও শুনলেন না তিনি। আরেকবার আস্তে বলার পরই ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আপনি যাত্রী, চুপ করে বসে থাকুন।

এরই মধ্যে একটি বাসের সঙ্গে লাগালো ধাক্কা। দ্রুত রিকশা থামিয়ে একেবারে বাসের সামনে গিয়ে হাজির রিকশাচালক। বাসচালককে ক্ষেপে বললেন, ট্রাফিকের একটি হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে দিতে পারো আর আমার এতো বড় রিকশা তোমার চোখে পড়ে না।

এরই মধ্যে বাসচালক তার গালে বসিয়ে দিল এক থাপ্পড়। শুরু হলো চরম উত্তেজনা। মানুষজন জমে গেল। শুরু হলো আপ-ডাউন। মারপিট। আসলে দেশ কোনো পথে যাচ্ছে? সর্বত্রই ক্ষোভ। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, বাসে- ট্রেনে, ঘরে-ঘরে।

সবার প্রশ্ন, কোন দিকে যাচ্ছে দেশ?  কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? অরাজকতা কোথায় হচ্ছে না? আগে যা হতো রাতের আঁধারে, এখন হচ্ছে দিনের আলোয়। একেবারে প্রকাশ্যে। কোনো কিছুরই প্রতিকার নেই। প্রতিবাদ জানাতে গেলেও বাধা। সাধারণত দুর্বলরাই তো প্রতিবাদ জানায়।
রাজপথে স্লোগান তোলে। আজ প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলছে দুর্বলরা। কথাও বলতে পারছে না মন খুলে। রাজপথে দাঁড়ালেই সবলদের রক্তচক্ষু। কিন্তু পথ, ঘাট, হাট-বাজার আর বাস- ট্রেনের ক্ষুব্ধ মানুষদের কথা থামাবে কে? ঘরে ঘরে যে আলোচনা, সমালোচনা এর রেশ ঠেকাবে কে?

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণ সবই ঠাঁই পায় আলোচনায়। অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তো নিত্যদিনের বিষয়। বাসে কেউ একটি মন্তব্য করলে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যরা। তাদের যত ক্ষোভ রাজনীতির ওপর।

গতকাল বাসে এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ। এরই মধ্যে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া চাইলো কন্ডাক্টর। যাত্রাবাড়ী থেকে তিনি ফার্মগেট যাবেন। কত বলতেই কন্ডাক্টরের উত্তর ১৫ টাকা। ক্ষেপে গেলেন তিনি। উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন দেশটা কি মগের মুল্লুক? তুমি ১৫ টাকা চাইবে আর আমি দিয়ে দেব?

কন্ডাক্টরের পাল্টা জবাবÑ ক’দিন পর ২০ টাকা দিতে হবে। আরও ক্ষেপে গেলেন তিনি। এবার কন্ডাক্টর বললো, আমারে কন কেন? সরকারকে গিয়া কন তেলের দাম কমাইতে! আর যায় কোথায়? চারদিক শুরু হয়ে যায় নানা আলোচনা।

সবাই দেশ নিয়ে চিন্তিত। এদেশ এভাবেই চলবে? কোন দেশে আমরা বসবাস করছি। এমন কেন হচ্ছে? ৪০ বছরে দেশের অবস্থা যা হবার কথা তা হয়নি। এজন্য কারা দায়ী?

আসলে মানুষের শরীর যেমন ডায়াবেটিস হলে ক্ষয়ে যায়, দেশেরও অবস্থাও তাই। এখন হাইপো অবস্থায় আছে।

ওই বৃদ্ধ একটি গল্পও শোনালেন। তিনি বলেন, এক ডাক্তারের কথা। তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম ডাক্তারি করতে গিয়ে আপনার এমন কোনো মজার অভিজ্ঞতা আছে কি, যা আপনাকে হাসায়? তিনি বললেন, আছে। তাহলে শুনুনÑ এক ডায়াবেটিস রোগী ইনস্যুলিন নেন। নিয়ম হলো, ইনস্যুলিন নিলে তাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে খেতে হয়। কিন্তু একদিন আধ ঘণ্টা পেরিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। বেচারার স্ত্রী খাবার দিচ্ছে না। তার কাঁপুনি শুরু হয়েছে। রাগে ফুঁসছেন তিনি। এক সময় জোরে চিৎকার দিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে ‘পুড়া ...’ বলেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।

দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ওই ডাক্তার তার চিকিৎসা দিলেন। কিছুক্ষণ পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন তিনি। তখনই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো জোড়ে ‘মুখী’ শব্দ। ভয় পেয়ে যান ডাক্তার। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে সব শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধ স্ত্রীকে ‘পুড়ামুখী’ গালি দিতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু পুড়া বলার পরই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সংজ্ঞা ফিরে  পেয়ে বলেন বাকিটুকু। অর্থাৎ মুখী। ডায়াবেটিস রোগীর হাইপো হলে যেমন হয়, দেশের অবস্থাও এখন এমন। যতদ্রুত এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে দেশ- ততই মঙ্গল। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে।

সরকার ও বিরোধীদলের এ জন্য ছাড় দিতে হলেও তা দিতে হবে। নাকি এক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠবে কে কতটুকু ছাড় দেবেন? রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। মানুষ এখনও বিশ্বাস করে দুই বড় জোটের মধ্যে সমঝোতা হবে। আর সমঝোতার পরই সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

১৭/০৯/২০১৩/এমটিনিউজ২৪/এম আর/এস এম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে