মাহতাব শফি : সাদেক, হানিফ এবং সেতু, রীমা, রীদি কি সুন্দর নাম। ওরা একইসঙ্গে ঘুমায়। একই খাবার খায়। তবে পুরুষ-স্ত্রীর মধ্যে পার্থক্য তো আছে-ই।
এমন কোনো ব্যক্তি নেই ওদের চেনে না। ওরা মধ্যপ্রাচ্যের হলেও এসেছে বাংলাদেশে। ওদের বাসস্থান এখন মতিঝিলের আরামবাগে। মতিঝিলে থেকেই ওরা দুধ দেয়।
ওদের চিনতে গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে নাম-সংবলিত বোর্ড। বোর্ড দেখেই হানিফ-রীমাদের চেনা যায়।
সাদেক, হানিফরা পুরুষ উট। আর সেতু, রীমা, রীদিরা স্ত্রী উট। উটের দুধ স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে বেশ কার্যকর।
উটের দুধ শুধু ভিটামিনসমৃদ্ধ পানীয় নয় রোগীর পথ্য হিসেবেও বেশকিছু দেশে রয়েছে এর বাজার। যদিও গরুর দুধের বিপরীতে তা এখনো বিশ্বব্যাপী বাজার পায়নি।
বাংলাদেশের অন্য কোথাও পাওয়া না গেলেও উটের দুধ পাওয়া যায় রাজধানীর মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে দেওয়ানবাগ বাবে মদিনার পীর সাহেবের খামারে।
প্রতিদিনই বাবে মদিনার এ খামারে অসংখ্য দর্শনার্থী ও ক্রেতারা ভিড় জমায়। কৌতূহল নিয়েই সবাই দেখেন উটের খামার এবং ক্রয় করেন উটের দুধ।
২০০৪ সালে আড়াই বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠে দেওয়ানবাগ বাবে মদিনার পীর সাহেবের এই খামার। ওই বছর ঈদুল আজহায় ভারতের রাজস্থান থেকে গাবতলী হাটে আনা উট থেকে একটি পুরুষ ও নয়টি স্ত্রী উট বাবে মদিনায় পালার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়।
এরপর বিভিন্ন সময় আরও ৯টি উট ক্রয় করা হয়। এসব উট পরবর্তীতে বাচ্চা প্রসব করলে এক বছরের ব্যবধানে এখানে উটের সংখ্যা দাঁড়ায় পঁয়তাল্লিশে।
বিভিন্ন সময় ঈদুল আজহায় বাবে মদিনা উট বিক্রিও করে থাকে। বর্তমানে এ খামারে রয়েছে সাতচল্লিশটি উট।
খামারটির ভেতরের পরিবেশ সাজানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে এমন একটা খামার রয়েছে। চতুর্ভুজ আকৃতিতে গড়ে তোলা হয়েছে খামারের মধ্যকার অংশটুকু।
বাঁশ-কাঠ ব্যবহার করে উটের বাসোপযোগী করে খামার তৈরি করা হয়েছে। খামারের মধ্যকার অংশের বাইরের চারপাশ দিয়ে উট চলাচল করে। আর ভেতরের অংশে উট বিশ্রাম নেয়। এসব উট পালনে বাবে মদিনা কর্তৃপক্ষকে প্রথমে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার সাত বছর পর এ খামারে বর্তমানে চলছে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রজনন। আর বিশেষ ব্যবস্থায় চলে উটের লালন-পালন। বর্তমানে ২০ জন লোক সার্বক্ষণিক উট পরিচর্যায় নিয়োজিত রয়েছে। উটের চিকিৎসার জন্য রয়েছেন দু’জন পশু চিকিৎসক।
উটের খাবারেও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বিভিন্ন ধরনের ঘাস, খৈল, ভুষি, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয় এদের খাবার।
সপ্তাহজুড়ে একেকটি দলের স্বেচ্ছাসেবকরা একদিন করে খামারের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে। বাবে মদিনা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে চলে এ খামার।
বাবে মদিনার এ খামারের তত্ত্বাবধায়ক তসলিম উদ্দিন এমটিনিউজ২৪ডটকমকে বলেন, এখানে উট পালনে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যাতে স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি উটকে লালন-পালন করা যায়।
এছাড়া এই খামারকে আরো বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এদেশের উট পালনের প্রধান শর্ত হলো নিবিড় পরিচর্যা। উট পালন যথেষ্ট লাভজনক ব্যবসা। একটি মা উট আরেকটি বাচ্চা দেয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি দুধ দেয়। উট প্রথমবার একটি বাচ্চা দেয়। দ্বিতীয়বার থেকে দুই থেকে ৩টি করে বাচ্চা দেয়।
উট ৫০ বছর পর্যন্তও বাঁচে। এ সময়ে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি বাচ্চা দেয়।
তসলিম উদ্দিন আরো বলেন, সাধারণত উটের চর্মরোগ ও জ্বর হয়। কিন্তু চিকিৎসায় তা ভালো করা সম্ভব। উটের প্রধান শত্র“ কৃমি। ছয়মাস পর পর ভ্যাকসিন দিলে কৃমি দমন হয়। একটি উট যে কোনো রোগ অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে আক্রান্ত হলেও অসুস্থ অবস্থায় কমপক্ষে দুই মাস বেঁচে থাকে।
এ সময়ের মধ্যে এটিকে সারিয়ে তোলা বা জবাই করে মাংস বিক্রি করা যায়। ফলে রোগবালাই সত্ত্বেও উট পালনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না।
এদিকে মুরিদানদের দাবি, উটের মাংস এবং উটের দুধ খেলে যেকোনো কঠিন রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি উটের মাংসের দাম ১০০০টাকা এবং প্রতি কেজি দুধের দাম ৩৫০ টাকা।
বর্তমানে খামারের চারটি উট দুধ দিচ্ছে বলে জানান মুরিদানরা। একেকটি উট প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ লিটার দুধ দেয়। উটের দুধ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাউ) উদ্যোগে সৌদি অ্যারাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজেশন (এসএসও) উটের দুধের ওপর একটি গবেষণা চালায়।
এ গবেষণায় চিকিৎসক আর ইয়াগিল উল্লেখ করেছেন, উটের দুধ পান করলে মানবদেহের জটিল কিছু রোগব্যাধি নিরাময় হয়। যেমন- জন্ডিস, হাঁপানি, পেটের পীড়া, রক্তশূন্যতা, পাইলস, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, নানা সংক্রমণ, পেটের আলসার, চর্মরোগসহ প্রায় ২০টি জটিল রোগ।
উটের দুধে রয়েছে গরুর দুধের চেয়ে তিনগুণ ভিটামিন সি, রয়েছে ভিটামিন বি। তুলনামূলক ফ্যাট ও ল্যাকটোস কম এবং বেশি ইনস্যুলিন রয়েছে।
বেশকিছু দেশে ডায়াবেটিস রোগী, এইডস, লিবার ক্যান্সার আক্রান্ত ও অটিজম রোগীকে উটের দুধ খাবার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা।
১৯.১০.২০১৩/এমটিনিউজ২৪/প্রতিবেদক/এমআর