বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ০৫:২৭:৩৯

নিজের স্ত্রীকে ভুলে যে নারীর প্রেমে পড়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী!

নিজের স্ত্রীকে ভুলে যে নারীর প্রেমে পড়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী!

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানকারী মহিলাদের মধ্যে অন্যতম বড় মুখ। বিদেশী কাপড় বর্জন থেকে শুরু করে রুডওয়ার্ড কিপলিংকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে তরুণদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন লাঠি, ছুড়ি।

উদাত্ত কণ্ঠে বন্দে মাতরম গেয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের বিদ্বদজনদের। শিল্প সাহিত্যের পরিবার থেকে বড় হওয়া এই নারীর ধ্যান ধারনা ছিল সম্পূর্ণ রূপ। সেই তিনিই তার রূপে, গুণে পাগল করেছিলেন ভারতের জাতীর জনক মহাত্মাকে। তিনি সরলাদেবী চৌধুরানী।

সরলাদেবীর পারিবারিক পরিচয় যদি দেখা হয়, তাহলে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নী। রবীন্দ্রনাথের দিদি এবং বাংলার প্রথম মহিলা উপন্যাস লেখিকা স্বর্ণকুমারীদেবীর দ্বিতীয় কন্যা সরলা। বাবা জানকীনাথ নদীয়ার জয়রামপুরের বিখ্যাত ঘোষাল বংশের সন্তান এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। 

এমন মেয়ের যে গুণে সরস্বতী আবার কর্মে হুংকারিনি হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গান্ধীজীর প্রেমিকা। হ্যাঁ এটাও সত্য। গান্ধীজী যেমন তার প্রতি নিজের ভালোবাসাকে স্বীকার করেছেন। সরলাদেবীও তেমনই তার ভালোবাসা মোহনদাসের প্রতি ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন। 

জীবনীতেই গান্ধীজীর প্রতি তার ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ বা ‘সফট কর্নার’ তৈরির আভাস দিয়েছেন। জীবনের ঝড়াপাতা বইতে গান্ধীজী সম্পর্কে সরলদেবীর প্রথম পরিচয়ের কথা লেখা রয়েছে। এটা ১৯০১ সালের কথা। 

তিনি লিখেছেন, ‘তখনও তিনি মহাত্মা গান্ধী হননি। আমাদের বাড়িতে একটি সায়াহ্ন পার্টিতে তিনি এলেন। দেখতে শুনতে চটকদার নয়। তবে গালভরা হাসিতে ভরা, মাথায় ‘পিরিলি পাগড়ি’ পরা। অল্পক্ষণের জন্য তার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। পড়ে তিনি আমায় গল্প করেন, আমায় কিরকম সমীহের চোখে দেখলেন সেদিন।

কেননা আমার পিতা যিনি কংগ্রেসের অক্লান্ত কর্মী জেনারেল সেক্রেটারি তার কন্যা আমি। আমার নিজস্ব কাজকর্মের কোনও পরিচয় তিনি পাননি। আমি তখন ভারতীর (পত্রিকা) জন্য মৃগয়াপরায়ণ, সিঙ্ঘান্বেশী- সেই চোখেই গান্ধীজীকে দেখেছিলুম। ইনি ভারতীয়দের হয়ে বিদেশে কাজ করায় নামকরা একটি সিংহ হয়েছেন, এর কাছ থেকে একটা লেখা আদায় করতে পারলে বেশ হয়।”

এর মাঝে তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না সরলাদেবী ও গান্ধীজীর মাঝে। আসল নিবিড় সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯১৯ সালে। ‘Mohandas: A True Story of a Man, His People, and an Empire’ এই বইতে রাজামোহন গান্ধী লিখেছেন, “১৯১৯ সালের ২৪ অক্টোবর গান্ধীজী লাহোরে যান” 

প্রসঙ্গত ইতিমধ্যেই সরলাদেবী বিবাহিতা। এক পুত্র সন্তানের মা। স্বামী রামভূজ দত্ত চৌধুরী, যিনি নিজেও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালা হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে গিয়ে লাহোরে এই রামভূজ দত্ত চৌধুরী বাড়িতেই আশ্রয় নেন গান্ধীজী। এবং নতুন করে সরলা দেবীর সঙ্গে গান্ধীজীর সম্পর্কের শুরু।

গান্ধীজী তখন ৪৭ , সরলাদেবী ২৯এর কোঠায়। রাজামোহন গান্ধী লিখেছেন , “গান্ধীজী যখন রামভূজ দত্ত চৌধুরী বাড়িতে থাকছেন , রামভূজ তখন জেলে। এই সময় আহমেদাবাদে গান্ধীজী একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, “সরলাদেবীর সান্নিধ্যে আমি আপ্লুত। উনি আমার দারুণ সেবা করেছেন। এরপরের কিছু মাস ধরে নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে গান্ধীজী ও সরলাদেবীর সম্পর্ক যা ১৯২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত মারাত্মক ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল।”

তার এবং সরলাদেবীর সম্পর্ককে গান্ধীজী এক আধ্যাত্মিক বৈবাহিক সম্পর্কের পরিচয় দিয়েছিলেন লেখকের ভাষায় ‘spiritual marriage’। গান্ধীজী একটি চিঠিতে এই spiritual marriage এর ব্যখ্যা দিয়েছেন। 

তিনি লিখেছেন, “আমাদের দুজনের বন্ধন এমন একটা বন্ধন যা কোনও শারীরিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। এটা সম্ভবত দুই ব্রহ্মচারীর মধ্যেই হতে পারে যাদের ভাবনা, চিন্তা, লেখাপত্র সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়।”

ওই বইয়ের তথ্য অনুযায়ী গান্ধীজী একটি চিঠিতে লিখেছেন , “তুমি আমার স্বপনে, শয়নে বিরাজ করছ। আমার মনের প্রতিটি কোনায় তোমার জন্য ভালোবাসা রয়েছে। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার তোমার ভালোবাসার প্রতি আমার কতটা আকর্ষণ রয়েছেন। এই হল সেই উত্তর।” 

মার্টিন গ্রিন তাদের সম্পর্ক নিয়ে সবথেকে বেশী রিসার্চ করেছেন। তার বইতে তিনি লিখেছেন, “একটা অসাধারণ রাজনৈতিক গাঁটবন্ধন দেখতে পাচ্ছিলাম। দুজনে মিলে নিজেদের সম্পর্কের মতোই এক নতুন ভারত তৈরির ছবি একে ফেলেছিলেন।”

বইয়ের তথ্য বলছে দুজনের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, ওই সম্পর্কের কারণে গান্ধীজীর বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা পৌঁছাতে শুরু করেছিল গান্ধীর ঘনিষ্ঠদের কানে। তার পরিবারেও ব্যাপক ঝামেলা হয়। মহাত্মার পুত্র দেবাদাসও এই সম্পর্ককে কিভাবে সামাল দেবেন তা নিয়ে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ধর্মপত্নী কস্তুরবা গান্ধীর জেদের কাছে মহাত্মা পিছু হঠতে বাধ্য হন। গান্ধীজীর সঙ্গে কস্তুরবার মনের মিলের দিক থেকে একটা ফাঁক ছিলই। সেই অভাব পূরণ করতে পেরেছিলেন শিক্ষিত সরলাদেবী। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে। প্রায় ১০০ বছর পেরিয়েও অমর সরলাদেবী ও গান্ধীজীর প্রেম কাহিনী। আরেকটি প্রেমের গল্পের চেয়ে কম কোথায়?

হঠাৎই নিজেকে সরলাদেবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন গান্ধীজি। পরে হিমালয়ে আধাত্মিক জীবন যাপনের লক্ষ্যে চলে গিয়েছিলেন সরলাদেবীও। প্রসঙ্গত সরলাদেবীর একমাত্র পুত্র দীপক দত্তর বিয়ে হয় মহাত্মা গান্ধীর নাতনি রাধার সঙ্গেই।

সরলা দেবীর বৈপ্লবিক পরিচয়টাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অস্ত্রশিক্ষার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সরলাদেবী। মারাঠিদের ‘শিবাজী উৎসব’-এর অনুকরণে তিনি ১৯০৩ সালে কলকাতায় শুরু করছিলেন ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’। সঙ্গে প্রকাশ করলেন বঙ্গের বীরদের নিয়ে ছোট ছোট পুস্তিকা। 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বহু আগে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার ও প্রচার করার জন্য ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে একটা দোকান খুলেছিলেন। সারা বাংলাদেশের সমস্ত জেলা থেকে সেখানে সংগ্রহ করে আনা হত স্বদেশি বস্ত্র ও মহিলাদের ব্যবহার্য পণ্য। কোথাও যেতে হলে নিজেও আপাদমস্তক স্বদেশি বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে বেরোতেন। 

১৯১০ সালে এলাহাবাদে ভারতের প্রথম মহিলা সংগঠন ‘ভারত স্ত্রীমহামণ্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট মুসৌরীতে স্বামী রামভজের মৃত্যুতে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সরলা। পাঞ্জাব থেকে ফিরে দিদি হিরণ্ময়ীদেবীর সঙ্গে ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনা ও অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।

১৯৩০ সালে কলকাতায় খোলেন ‘ভারত স্ত্রী শিক্ষা সদন’ নামে মেয়েদের স্কুল। প্রথমে বিপ্লবী আদর্শে চালিত হলেও পরে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতি ও অসহযোগ আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সরলা। ভারতী সম্পাদনার সূত্রে স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে আসেন। 

স্বামীজী সরলার গুণের অত্যন্ত প্রশংসা করতেন। বলতেন ‘সরলা নারীকুলের রত্ন’। সরলার মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। শেষজীবনে বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্ম্মা নামে হাওড়া নিবাসী এক সাধককে গুরুপদে বরণ করেছিলেন। নিয়মিত সেখানে যেতেন। আশ্রমের আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্মেও অংশ নিতেন। ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ১৮ আগষ্ট ৭২ বছর বয়সে একান্ত জীবনযাপন কালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

তথ্য সূত্র: জীবনের ঝরা পাতাগুলি, Mohandas: A True Story of a Man, His People, and an Empire, কলকাতা ২৪*৭।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে