প্রেমিকার ডাকে সাইকেল চেপে দিল্লি থেকে সুইডেনে!
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রেমের ডাকে সাত সমুদ্র পাড়ি, কাঁটাতার বেদ করে প্রবেশ করা এমন নানা ঘটনা আজকাল শোনা যায়। মমতাজকে অমর করে রাখতে তাজমহল গড়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। উনি, ড. প্রাদ্যুমনা কুমার মহানন্দিয়া প্রেমের জন্য দিল্লি থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুইডেনে। তাও আবার লক্করঝক্কর একটা সাইকেল নিয়ে। প্রেমের প্রতিশ্রুতি যদি হয়, তো এমনই।
ওডিশার দলিত পরিবারে জন্ম। ধোপা বাড়ির ছেলে। তাচ্ছিল্য ছাড়া প্রতিবেশীদের থেকে আর কিছু জোটেনি। এমনকি স্কুলে গিয়েও সহপাঠীদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাননি। শিক্ষকরাও যে ভালো চোখে দেখতেন, তা-ও নয়। পদে পদে বৈষম্য আর লাঞ্ছনা। তাই একরকম বাধ্য হয়েই চলে গিয়েছেলেন দিল্লিতে। ভর্তি হন আর্ট কলেজে। সেটা ১৯৭১ সাল।
প্রতিভাকে চেপে রাখা যায় না। ডানা মেলতে থাকে তার শিল্পীসত্তা। ক্রমে চিত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ওডিশার সেই দলিত পরিবারের সেই যুবকটি। ভারতের সীমানা পেরিয়ে লন্ডনের শিল্পদুনিয়ার লোকজনের কাছেও তখন পৌঁছে গিয়েছেন প্রাদ্যুমনা কুমার মহানন্দিয়া।
বছর উনিশের শার্লট ভন তখন লন্ডনে পড়াশোনা করছেন। অনেকদিন ধরেই ভালো শিল্পীর খোঁজে ছিলেন, যাকে দিয়ে তিনি নিজের পোর্ট্রেট
আঁকাবেন। বিভিন্ন সূত্র মারফত্ জানতে পারেন, পোর্ট্রেট আঁকাতে হলে প্রাদ্যুমনাই সঠিক ব্যক্তি। খোঁজখবর করে, তারপর একদিন ভারতে এসে হাজির সেই বিদেশিনি।
ক্যানভাসে বিদেশিনির প্রতিকৃতি ধরতে গিয়ে, মনজমিনেও এঁকে ফেলেন যুবতীকে। অর্থাত্ যেমনটি দেখা যায় বলিউডি ছবিতে, তেমনিভাবেই প্রেমে পড়া। ভালোবেসে ফেলেন সেই বিদেশিনিও।
প্রেমের সেই উত্তুঙ্গু দিনে, একদিন নিজের নামটাও বদলে ফেললেন বিদেশিনি। যাতে আরও বেশি ভারতীয় হয়ে ওঠা যায়। সহজে মিশে যাওয়া যায় ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। শার্লট তখন চারুলতা। অপেক্ষা না করে বিয়েও করে ফেললেন।
তারপর দেশে ফিরতে হত চারুলতাকে। ভেবেছিলেন, প্রাদ্যুমনাকে সঙ্গে নিয়েই যাবেন সুইডেন। কিন্তু প্রাদ্যুমনার মন চারুলতায় পড়ে থাকলেও পড়া যে তখনও শেষ হয়নি। তাই দিল্লি ছাড়া হয়নি চারুলতার স্বামীর। তবে স্ত্রীকে কথা দেন, একদিন তিনি নিশ্চয়ই যাবেন। অগত্যা একাই ফিরে যান চারুলতা। তবে ভরসা ছিল। জানতেন, প্রাদ্যুমনা তাকে ঠকাবে না।
চোখের বাহির সবসময় যে মনের বাহির করে না, চারুলতা-প্রাদ্যুমনা প্রেম তারই দৃষ্টান্ত। পড়া শেষে শিল্পী ঠিক করলেন, এবার যেতে হবে সুইডেনে। সেখানে অপেক্ষায় চারু। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল অর্থ।
এটা সেটা বেচেও পর্যাপ্ত টাকার ব্যবস্থা হলো না। এর মধ্যে একবার শার্লট ভন প্লেনের টিকিটও পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন তার প্রেমিক স্বামী। স্ত্রীকে জানান, নিজের রোজগারের টাকাতেই যেতে চান সুইডেনে।
১৯৭৮ সাল। সম্বল বলতে, সদ্য কেনা পুরনো এক সাইকেল। ঠিক করলেন, সেই বাহনে চেপেই পৌঁছবেন সুইডেনে। সৃজনশীল পুরুষরা বোধহয় এমন খ্যাপাই হন। ওই বছরই রওনা দিলেন। দিল্লি থেকে অমৃতসর, আফগানিস্তান, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লোভিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া হয়ে ডেনমার্ক। লেগে যায় সাড়ে ৪ মাস। পথে বেশ কয়েকবার সাইকেল খারাপ হয়েছে। এটা ভেঙেছে, সেটা গেছে।
বাধা পেলেন গিয়ে সুইডেনের গোথেনবুর্গে। এভাবে তার সুইডেনে পৌঁছনোর কারণ, সুইডিশ অভিবাসন দফতরের আধিকারিকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। তারা বিশ্বাসই করছিলেন না, দিল্লি থেকে সাইকেলে এতটা পথ পেরিয়ে কেউ সুইডেনে আসতে পারেন। এরই মধ্যে সেখানে পৌঁছে যান চারুলতাও।
পরিবার মানবে কি না এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন শার্লটের পরিবার। শেষ পর্যন্ত যদিও প্রাদ্যুমনাকে নিয়ে কোনো সমস্যাই হয়নি। এখন সুইডেনই তার ঠিকানা। দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবনেরও চল্লিশটা বছর পেছনে ফেলে এসেছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার। এখন তিনি সুইডেনে ভারতের ওডিশা কালচারাল অ্যাম্বাসেডর। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
১৫ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম
�