বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ০৫:০৫:০৮

উপমহাদেশের বৃহৎ পতিতাপল্লি কলকাতার সোনাগাছির তিন মেয়ের গল্প

উপমহাদেশের বৃহৎ পতিতাপল্লি কলকাতার সোনাগাছির তিন মেয়ের গল্প

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : সাতচল্লিশ সাল। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়ে স্বাধীন হল ভারতবর্ষ। দেখতে দেখতে সাত দশক পার। এই বিরাট সময়কালে বদলে গেছে অনেক কিছুই। আসলে বদলানোরই তো কথা ছিল।

আবার বদলালো না অনেক কিছুই। এই যেমন লাল দুনিয়া। সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন পেশা হিসাবে সেমিনারে-বৈঠকে আলোচনা হল বিস্তর। কিন্তু, কতটা বদলালো আজকের রেডলাইটের জীবন? 

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে লাল দুনিয়ার সাদা-কালো এঁদো গলিতে ঢুঁ মারল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। আর তাতেই উঠে এলো তিন কন্যার গল্প।

সোনাগাছির কোহিনুর : বাবা-মায়ের কহিনুর শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন। শিক্ষা হল বটে মেয়েটার। বাবা-মা-ভাই আর কহিনুর, এই হল পরিবার। ছোটো বেলায় স্কুল থেকেই শিক্ষিকা হওয়ার বাসনা জাগে মনে। কিন্তু, বাচ্চা মেয়েটা জানত, অনটনের সংরক্ষণশীল পরিবারে তার এই ইচ্ছা বিশেষ আমল পাবে না। 

তবু, ‘ইচ্ছা হল এক ধরনের গঙ্গা ফড়িং’। কহিনুর মনের কথা বলে ফেলল বন্ধু শবনমকে। এরপর দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল। কহিনুরের স্বপ্ন সফল করতে শবনম বন্ধুকে নিয়ে এলো কলকাতার শোভাবাজারে।

শবনম এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কহিনুরকে। কহিনুরের বাড়ির লোক কিন্তু এসব কিচ্ছুটি জানে না। জানবেই বা কী করে! ওরা যে বাড়িতে না বলে পালিয়ে এসেছে। শবনমের পরিচয় করিয়ে দেওয়া মানুষটার হাত ধরে স্বপ্ন সাকার করার স্বপ্ন দেখছিল যে মেয়েটা, তার হঠাৎ সংবিৎ ফিরল। 

এ কোথায় এসে পড়েছে সে! এখানে যে সবাই ছুঁতে চায়। শুতে চায়। কেউ শুনতে চায় না। অচিরেই সে জেনে ফেলে, সোনাগাছিতে একবার চলে এলে আর পালাবার পথ নেই।

কিন্তু, যে মেয়ে শুধু পড়বে আর পড়াবে বলে বাবা-মার কোল ছেড়ে এসেছে, তাকে আটকানো কি অতই সহজ! বাবু আসে, বাবু যায় দিন বদলায় না… তবে এরমধ্যে হঠাৎ একটা মনের মানুষ (বাবু) খুঁজে পান কহিনুর। সেই বাবু লাল-নীল স্বপ্ন দেখান।

কহিনুরকে সিনেমা দেখাবে বলে সোনাগছির চৌহদ্দি থেকে বের করে নিয়ে গেল। এরপর সোজা বিহার। বাবু-বিবির লাল-নীল সংসার। মন খুশ কহিনুরের। অচিরেই গর্ভে এল সন্তান। ততদিনে পেটে থাকা স্বপ্নটা বিভোর করেছে কহিনুরকে। কিন্তু, পোড়ামুখীর কপালে সুখ সইলে তো।

কহিনুর অচিরেই জানতে পারেন, বাবুর একাধিক বিয়ে। অন্যত্র সংসারও আছে। আর কথায় বলে, জ্ঞান দুঃখ দেয়। কহিনুরের এই জ্ঞানটাই কাল হল। রাতে শুরু হল মারধর। অনাপোশী মেয়ে ছেড়ে দিল স্বামীর ঘর। 

কিন্তু, যাবে কোথায়? কেন! সোনাগাছির ভাত জোগাড়ের বিছানা তো পাতাই আছে। খেটে খাবে কহিনুর। পুরানো মহল্লায় ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই জন্মাবে নতুন প্রাণ।

কোহিনুর চাননি, ছেলেকে দূরে রেখে, মায়ের পরিচয় লুকিয়ে সমাজের দশ জনের একজন করতে। বরং তিনি চেয়েছিলেন, ছেলে দেখুক মায়ের সংগ্রাম। মাসের পর মাস দরজার করায় দড়ি দিয়ে আটকানো থাকত ছেলে, আর ঘরের ভিতর কাজ করতেন মা। 

প্রায়ই ছেলের কান্না, বাবুর মেজাজ মিলেমিশে বালিশ ভেজাত কহিনুরের। তবু এক রোখা মা, ছেলেকে সোনাগাছিতে রেখেই মানুষ করার সিদ্ধান্তে অটল। নিজে শিক্ষক হতে পারেননি, তাই ছেলের মধ্যে দিয়ে স্বপ্ন স্বার্থক করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন মা। কহিনুরের ছেলে মাস্টার হল। মা এরপর ব্যাটার বিয়ে ঠিক করলো এক যৌনকর্মীর সঙ্গেই।

ছেলেকে যে জীবনের সার শিক্ষা দিয়েছেন কহিনুর। তাই তার পুত্রবধূ নির্বাচনে কোনও দোলাচল ছিল না। তবে, বিয়ের পর কহিনুরের পুত্রবধূ কেবল ঘর-সংসারই করছেন, আর পুত্র করছেন উপার্জন। আজ কহিনুরের দুই নাতি-নাতনি। 

সকালবেলায় ঠাম্মি তাদের পড়াতে বসান-‘অ’য় আজগর আসছে তেড়ে, আ’য় আমটি খাব পেড়ে’…কহিনুর শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন।

হাড়কাটার নীলিমা : মুর্শিদাবাদের মেয়েটার তখন সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। সে কোনওদিন কলকাতা দেখেনি। বিয়ের পর স্বামীকে সে কথা জানানোর পরই দে ছুট। নবাবের মুলুক ছেড়ে সোজা জব চার্নকের শহর। ভিক্টোরিয়া, হাওড়া ব্রিজ, জাদুঘর, গড়ের মাঠ- কত কিছু দেখার ইচ্ছা ছিল নীলিমার। 

স্বামী বললেন সবই হবে, কিন্তু আপাতত এক ‘বন্ধু’র বাড়িতে তো উঠতে হবে। বন্ধুর বাড়িতেই উঠল নব দম্পতি। এরপর ‘একটু আসছি’ বলে বেরলেন স্বামী। তারপর বেশ কয়েক ঘণ্টা তার আর কোনও খোঁজ নেই। 

কোথায় গেল লোকটা? দিন দুয়েক কেটেও গেল এর মধ্যে। এভাবে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না, তাই স্বামীর ‘বন্ধু’ বলল, খুঁজতে বেরতে হবে। এরপর সেই ‘বন্ধু’র হাত ধরে আরেক ‘বন্ধু’র বাড়ি…হঠাৎ নীলিমা বুঝলেন, ‘বন্ধু’দের সৌজন্যে তার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। 

তিনি এসে পড়েছেন কলকাতার হাড়কাটা গলিতে। সেই থেকেই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নীলিমার নয়া যাপন শুরু। সকাল-বিকাল কাজ করে চলেছে মেয়েটা। আর এরসঙ্গে দুর্বারের সৌজন্যে চলছে নাচ-গান শিক্ষা। এখন সবকিছুর সঙ্গে বেশ ভালই মানিয়ে নিয়েছেন নীলিমা।

হাড়কাটার হিসাবের খাতা বলছে, নীলিমা এখানে অন্যতম ‘হাই ডিমান্ড’। বাবুরা তাকে নিত্য উপহারও দেন। বিয়ের প্রস্তাবও আসছে অহরহ। তবে এসব শুনলেই তার ঠোঁটে ঝিলিক দেয় চিলতে হাসি, পছন্দের টেডি বিয়ারটাকে জাপটে ধরে হাট করে খোলা জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন নীলিমা। নীলিমা শুনেছেন, ভিক্টোরিয়ার মাথায় পরীটা আর ঘোরে না, থেমে গিয়েছে।

মাটিয়ার আমিনা : স্বামী-সন্তান নিয়ে আমিনা বিবির বেশ সুখেই কাটছিল দিন। সুখ আরও বাড়বে। কারণ, আমিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু, অচমকা স্বপ্নভঙ্গ! হঠাৎ আমিনার স্বামীর মৃত্যু হল। গর্ভে তখন পাঁচ মাসের সন্তান। শ্বশুরবাড়ি দায় ঝেড়ে ফেলল। 

এক সন্তানের হাত ধরে গর্ভবতী আমিনা গেলেন বনগাঁয় বাপেরবাড়ি। কিন্তু, সেখানেও যে অনটনের একশেষ। বাবা জানিয়ে দিলেন, এতগুলো পেট তিনি চালাতে পারবেন না। কিন্তু, নিজের মেয়ে-নাতিকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না।

তাই, বসিরহাটে এক পরিচিতের কাছে নিয়ে গেলেন কাজের আশায়। সেই পরিচিত কাজ জোগাড়ের আশ্বাসও দিলেন এবং কথাও রাখলেন। দিন কয়েকের মধ্যে আমিনার একটা হিল্লে হয়ে গেল। তিনি কাজ পেলেন মাটিয়া যৌনপল্লিতে।

এরপর দেখতে দেখতে কুড়িটা বছর এখানেই কাটিয়ে ফেললেন আমিনা বিবি। মুসলিম আমিনার ঘরে ঈশ্বর-আল্লাহ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছেন। যে গর্ভের সন্তানকে নিয়ে সেদিন বাড়ি ছেড়েছিলেন আমিনা, সেই ছেলে মায়ের পরিচয় জেনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

নিজের থেকে দূরে রেখে বোর্ডিয়ে ভর্তি করে ছেলে-মেয়ে দুইটাকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন মা। কিন্তু, মায়ের পেশার কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়ে ছেলে, মাধ্যমিকের পর ছেড়ে দেয় লেখাপড়া।

এদিকে, মেয়ের শর্তাধীন বিয়ে হয়েছে। সেই মেয়ের এক মেয়েও হয়েছে আবার। কিন্তু, মেয়ে-নাতনি কাউকেই দেখতে পান না আমিনা। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির একটাই শর্ত ছিল, মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না। 

বুকে পাথর রেখে সেই শর্তে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন মা। কিন্তু, এখন যে আর মন মানে না। মরার আগে একটিবার মেয়ে-নানতিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে চান আমিনা…ঈশ্বর-আল্লার দিকে চেয়ে দিন গুনছেন আমিনা বিবি… 

(নিষিদ্ধ পল্লীর নারীদের নামগুলি পরিবর্তীত) সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে