শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ০১:০০:৫৫

ধারের টাকায় ব্যবসা শুরু করে এখন ৩০ হাজার কোটি টাকার বৃহৎ শিল্পগ্রুপ

ধারের টাকায় ব্যবসা শুরু করে এখন ৩০ হাজার কোটি টাকার বৃহৎ শিল্পগ্রুপ

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: ইউনাইটেড গ্রুপ। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্পগ্রুপ। ব্যবসায়িক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির এ সাফল্যের পুরোটা জুড়েই রয়েছে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের গল্প। সেই গল্পের শুরুটা হয়েছিল হঠাৎ করে। ১৯৭৮ সালে। বলতে গেলে শূন্য হাতে। ধারের টাকায়। শুরুতে সঞ্চয় বলতে শুধু ছিল অসী'ম সাহস, বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধন আর অক্লান্ত পরিশ্রমের শক্তি।

এ তিনে মিলে শূন্য পুঁজিতে ধারের টাকায় শুরু করা সেই কোম্পানি এখন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বৃহৎ শিল্পগ্রুপ। ইউনাইটেড গ্রুপকে চেনেন না এ রকম মানুষ খুব কম আছে নিশ্চয়। যাঁরা চেনেন না, তাঁদের জন্য দুটি তথ্য এখানে উল্লেখ করছি। ইউনাইটেড হসপিটাল ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিশ্চয় শুনেছেন।

আবার সাম্প্রতিক সময়ের চেইন সুপারশপ ইউনিমার্টের সঙ্গে অনেকে পরিচিত। চিকিৎসা, শিক্ষা খাতের স্বনামধন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সুপারশপ ইউনিমার্টের উদ্যোক্তা এ ইউনাইটেড গ্রুপ। শিক্ষা, চিকিৎসা ছাড়াও বিদ্যুৎ–জ্বালানি, রেস্টুরেন্ট, আবাসন, হোটেল থেকে শুরু করে বেসরকারি বন্দর, লজি'স্টিকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এ শিল্পগ্রুপ।

চলুন, ফিরে যাই শূন্য থেকে বিপুল, বিশাল হয়ে ওঠা গ্রুপটির শুরুর গল্পে। ১৯৭৮ সালে এটির যাত্রা শুরু হয় চার বন্ধুর হাত ধরে। তাঁরা হলেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, বর্তমান পরিচালক আহমেদ ইসমাইল হোসেন, আকতার মাহমুদ রানা ও খোন্দকার মইনুল আহসান শামীম। পরে এসে গ্রুপটির সঙ্গে যুক্ত হন তাঁদের আরও দুই বন্ধু আবুল কালাম আযাদ ও ফরিদুর রহমান খান।

এ দুজনের মধ্যে আবুল কালাম আযাদ বর্তমানে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও ফরিদুর রহমান খান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই হিসাবে বলা যায়, আজকের ইউনাইটেড গ্রুপ ছয় বন্ধুর ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা, একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও হা'ড়খা'টুনি পরিশ্রমেরই ফসল। যে বন্ধুতা হঠাৎ করে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শিক্ষার্থী থেকে তাঁদের ব্যবসায়ী করে তুলেছেন।

প্রথম প্রজন্মের হাত ধরে ইউনাইটেড গ্রুপের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্ম। অর্থাৎ বাপ–চাচার শুরু করা ব্যবসার হাল ধরেছেন সন্তানেরা। গত মঙ্গলবার গুলশানের ইউনাইটেড হাউসে বসে এ দুই প্রজন্মের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। গল্পে–আড্ডায়, হাসি–তামাশায় তারা শোনালেন শূন্য থেকে শুরু করা এ গ্রুপের আজকের মহিরুহ হয়ে ওঠার নানা গল্প। এ গল্প যেন অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অনন্য সাফল্যেরই এক বিরল দৃষ্টান্ত।

ব্যবসার শুরু যেভাবে: আড্ডা, গল্পে ভালোই কাটছিল তাঁদের দিন। সবাই তখন শিক্ষার্থী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ফুটপাতে বসে নিয়মিত আড্ডা ছিল বন্ধুদের। আড্ডায় আড্ডায় একদিন হঠাৎ করে এক বন্ধুর আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রস্তাব আসে ঠিকাদারি এক ব্যবসার। ১৯৭৮ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) আমদানি করা পণ্য খালাসের একটি কাজ পায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু মূলধন–সংকটের কারণে কাজটি করা সম্ভব ছিল না প্রতিষ্ঠানটির। তাই ঠিকাদারি কাজসহ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর তা কেনার প্রস্তাব আসে আহমেদ ইসমাইল হোসেন, খোন্দকার মইনুল আহসান শামীম, আকতার মাহমুদ রানা ও হাসান মাহমুদ রাজার কাছে।

তাৎক্ষণিকভাবেই রাজি হয়ে যান এ চার বন্ধু। ১৯৭৮ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রাবাসে এক বন্ধুর রুমে বসে ঠিক করেন টিসিবির ঠিকাদারির ব্যবসা তাঁরা শুরু করবেন। সেই থেকে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয় ১২ জুলাই।

তরুণ বয়সের তারুণ্যের উন্মাদনায় ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন চার বন্ধু। কিন্তু গন্ডগোল দেখা দিল ব্যবসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে। লাইসেন্স কেনা ও টিসিবির ঠিকাদারি কাজটি করতে হলে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে। এবার চার বন্ধু টাকা জোগাড়ের পেছনে ছুটতে লাগলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয় আরকি। টাকা জোগাড় করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। চার বন্ধুর একজন এবং গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজার এক নিকটাত্মীয়র হাতে তখন ছিল গাড়ি বিক্রির টাকা। সেই টাকা ধার নিয়ে যাত্রা শুরু তাঁদের ব্যবসার।

ট্রাকজীবন: টিসিবির ঠিকাদারি কাজ পেলেন, টাকাও জোগাড় হলো। এবার শুরু মাঠের কাজ। কাজ বলতে টিসিবির আনা পণ্য খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহ ও বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য খালাস করে তা তেজগাঁওয়ে টিসিবির গুদামে এনে বুঝিয়ে দেওয়া। পথে পণ্যের কোনো হেরফের হলে তার দায়দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।

এ যখন শর্ত, তখন চার বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন, পণ্য খালাস থেকে শুরু করে গুদামে পৌঁছে দেওয়া পুরো কাজে সশরীরে উপস্থিত থাকবেন তাঁরা। পালা করে এ দায়িত্ব পালন করবেন। সেই অনুযায়ী, একজন সব সময় পণ্য খালাসের কাজ তদারক করতেন, অন্যজন ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসে সেই পণ্য পৌঁছে দিতেন টিসিবির গুদামে। রাতের পর রাত কাটে ট্রাকে পণ্য বোঝাই করে তা গুদামে পৌঁছে দিয়ে।

কখনো কখনো এ কাজে বিরিয়ানির বিনিময়ে অন্যান্য বন্ধুরও সহায়তা নিয়েছেন। তাই চার বন্ধুর ব্যবসার শুরুর জীবনটি ‘ট্রাকময়’ ছিল বলে জানালেন গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা পরিচালক আহমেদ ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার শুরু থেকে আমরা নিজেরা সব কাজে যুক্ত ছিলাম। তাতে একদিকে আমাদের খরচ বেঁচেছে, অন্যদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের অনেক বেশি কাজে লেগেছে।’

ঠিকাদারি থেকে রেডিও এবং রাসায়নিক ব্যবসায়: টিসিবির ঠিকাদারি ব্যবসার পর চার বন্ধু যুক্ত হন রেডিও স্টেশনে ট্রান্সমিটার সরবরাহের কাজে। এটি ছিল পণ্য সরবরাহের বিপরীতে কমিশন–বাণিজ্য। বুলগেরিয়ায় তৈরি ট্রান্সমিটার এনে তা রেডিও স্টেশনে সরবরাহ করতেন তাঁরা। বিনিময়ে ট্রান্সমিটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভালো অঙ্কের কমিশন পেতেন।

ট্রান্সমিটার সরবরাহ করার পাশাপাশি ধীরে ধীরে রেডিও স্টেশন তৈরির কাজেও যুক্ত হয় গ্রুপটি তথা চার বন্ধু। ইউনাইটেড গ্রুপের উদ্যোক্তা পরিচালক খোন্দকার মইনুল আহসান শামীম জানান, বাংলাদেশ বেতারের ৭০ শতাংশ স্টুডিও ইউনাইটেড গ্রুপের হাতে তৈরি। ১৯৮১ সাল থেকে টানা ৩০ বছর বাংলাদেশ বেতারে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল গ্রুপটি।

১৯৮৩ সালে এসে তাঁরা যুক্ত হন রাসায়নিক সরবরাহের ব্যবসায়। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান কুপারসের এ দেশের ডিলারশিপ নেয় ইউনাইটেড গ্রুপ। সে সময় আরইবিতে বিপুল রাসায়নিকের প্রয়োজন পড়ত।

জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাসায়নিক এনে কমিশনের বিপরীতে তা সরবরাহ করত প্রতিষ্ঠানটি। আহমেদ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এ ব্যবসা করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, পণ্য আনতেই জাহাজ ভাড়া বাবদ বিপুল অর্থ দিতে হচ্ছে। তখন কুপারসকে প্রস্তাব দিলাম আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে জাহাজ ভাড়া করে সেই জাহাজে করে পণ্য আনার।

প্রথমে এ প্রস্তাবে তারা রাজি হয়নি, পরে আমরা তাদের বললাম, জাহাজে পণ্য আনতে গিয়ে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে তার দায় আমরা নেব। পরে আমরা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) সঙ্গে চুক্তি করে কম খরচে রাসায়নিক আনা শুরু করি। তাতে আমাদের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয়। যার ভাগ আমরাই পেয়েছিলাম।

এ ব্যবসা করতে গিয়ে আমাদের মাথায় আসে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার হয়ে জাহাজে করে তেল পরিবহন ব্যবসা করা যায়। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যবসায় যুক্ত হই আমরা। এ জন্য তেলবাহী জাহাজই কিনে ফেলি একটি। এক যুগ ব্যবহারের পর সেই জাহাজ বিক্রি করেও বিপুল মুনাফা হয়।’

ইউনাইটেড গ্রুপের উদ্যোক্তারা জানান, যে ব্যবসায় তাঁরা হাত দিয়েছেন, সেখানে নিজেরা যুক্ত থেকেছেন। কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ভাগ্যও বরাবর তাঁদের সহায় ছিলেন। তাই যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।

আরও দুই বন্ধুর এক হওয়া: শুরুটা করেছিলেন চার বন্ধু মিলে। ১৯৮৭–৮৮ এসে ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন আরও দুই বন্ধু। চাঁদপুরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি বাঁধ তৈরিকে কেন্দ্র করে এ দুই বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়। কাজটি ছিল পানিতে জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলে নদীভাঙন রোধ করা।

আগে থেকেই এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবুল কালাম আযাদ ও ফরিদুর রহমান খান। বিশ্বব্যাংকের এ প্রকল্পের কাজ পাওয়ার পর ইউনাইটেড গ্রুপ এ দুজনকে তাদের প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করে নেয়। এরপর থেকে ইউনাইটেড গ্রুপ হয়ে যায় ছয় বন্ধুর প্রতিষ্ঠান। আহমেদ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এ কাজ করতে গিয়ে আমরা বেলজিয়াম থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের তিনটি বিমানের কার্গো চার্টার হিসেবে ভাড়া করেছিলাম।

বিমানে করে বেলজিয়াম থেকে উন্নত মানের জিও টেক্সটাইল ব্যাগ নিয়ে এসেছিলাম। ওই সময় সংশ্লিষ্টদের কেউই বিশ্বাসই করতে পারেনি, আমরা এটি করব। সবাই ভেবেছিল, অসততার আশ্রয় নিয়ে কাজ বুঝিয়ে দেব। তাই আমরা যখন বিদেশ থেকে বিমানে করে পণ্য আনলাম, তখন বিমানবন্দরে সেসব ব্যাগ সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তারা। চাঁদপুরের ওই বাঁধ তৈরির পর মিরপুর বেড়িবাঁধের কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিল ইউনাইটেড গ্রুপ।

এরপরে বিদ্যুতের ব্যবসায়: ১৯৯৭ সালে এসে সামিট গ্রুপের সঙ্গে মিলে শুরু করে বিদ্যুতের ব্যবসা। ইউনাইটেড গ্রুপ ও সামিট মিলে প্রতিষ্ঠা করে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড বা কেপিসিএল। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানি বিদ্যুৎ খাতের দেশের প্রথম আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) প্রতিষ্ঠান।

১৯৯৮ সালে এসে কোম্পানিটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। কেপিসিএলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ইউনাইটেড গ্রুপের অধীনে বর্তমানে রয়েছে ১১টি বিদ্যুৎ প্রকল্প। এসব প্রকল্প থেকে ১ হাজার ৩১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কর্ণফুলী ইপিজেড ও পটুয়াখালীতে ৭৯০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার আলাদা দুটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের কাজ চলছে।

সাফল্যের মূলমন্ত্র ও শক্তি: গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা বলেন, ‘মানুষ সাধারণত যেসব ব্যবসা করতে চাইত না, আমরা সেসব ব্যবসা করেছি। আমাদের ব্যবসার বড় শক্তি ছিল, যে কাজই যখন করেছি, নিজেরাই সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কোনো ব্যবসা শুরুর পর ধীরে ধীরে ওই ব্যবসার সবটুকু বোঝার ও আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এ কারণে আমরা ভালোভাবে দর–কষাকষি করতে পারতাম।

অন্যরা যেখানে কম বা সামান্য লাভে বা মার্জিনে পণ্য সরবরাহের ব্যবসা করেছে, সেখানে আমরা বেশি মার্জিনে ব্যবসা করেছি।’ হাসান মাহমুদ আরও বলেন, ‘শুরু থেকে আমরা কখনো ব্যবসার জন্য ব্যাংকঋণনির্ভর ছিলাম না। শুরুতেই ঠিক করেছিলাম, ব্যাংকঋণ নিয়ে আমরা ব্যবসা করব না, যা করব নিজেদের অর্থে।

এখন এসে বলতে পারি, এ সিদ্ধান্তই আমাদের এত বড় হতে সহায়তা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসে একসঙ্গে আমরা বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছি। এ কারণে কিছু ব্যাংকঋণ করতে হয়েছে। চেষ্টায় আছি সেই অর্থ যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে দেওয়ার।’ গ্রুপের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘যেহেতু আমরা নগদ টাকায় ব্যবসা করি, তাই অনৈতিক পথে ব্যবসা করার কোনো তাগিদ আমাদের ছিল না।

এ কারণে অনেক ব্যবসা আমরা একমুহূর্তের সিদ্ধান্তে ছেড়ে দিয়েছি। তার জন্য আমাদের আর্থিক কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি মনে করি, নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য শক্তিশালী থাকলে তাতে ব্যবসার জন্য অনৈতিক পথ বেছে নিতে হয় না।’ এর বাইরে শুরু থেকে ব্যবসায় প্রতিশ্রুতি রক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানান হাসান মাহমুদ রাজা। তিনি বলেন, ‘এ কারণে মানুষ আমাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে।’

সবকিছু বিক্রিযোগ্য, তবে: হাসান মাহমুদ রাজা জানালেন, ইউনাইটেড গ্রুপের সব সম্পদই বিক্রিযোগ্য। পাশে বসা ছিলেন তাঁরই ছেলে ও গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ। পাশ থেকে বাবার কথা কিছুটা শুধরে দিয়ে বলেন, শুধু পরিবার ছাড়া বাকি সব ব্যবসায়িক সম্পদই তাঁদের বিক্রিযোগ্য। ভালো দাম পেলে সবই বিক্রি করতে তাঁরা রাজি।

সবকিছু বিক্রিযোগ্য—এই উদাহরণ দিতে গিয়ে হাসান মাহমুদ রাজা বলেন, গুলশানে বর্তমানে যেখানে ইউনাইটেড গ্রুপের কার্যালয়, সেটি তাঁদের দশম অফিস। এর আগে গুলশানে যে ভবনে তাঁদের অফিস ছিল, সেটি বড় এক শিল্পপতির কাছে এককথায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। গুলশানে বর্তমানে যেখানে লায়লা টাওয়ার, একসময় সেটির মালিকানায় ছিল ইউনাইটেড গ্রুপ। ভালো দাম পাওয়ায় সেটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ভালো দাম পেলে বর্তমান অফিসটিও বিক্রি করে দেব।

কেন সম্পদ গড়ে আবার সেই সম্পদ বিক্রি করে দেন—জানতে চাইলে হাসান মাহমুদ রাজা বলেন, ‘আপনি যখন লাভে কোনো সম্পদ বিক্রি করবেন, তখন ওই টাকায় আবারও সম্পদ তৈরি করতে পারবেন। হাতে টাকা থাকলে যেকোনো সময় সম্পদ তৈরি করা যায়। ধরা যাক, আমি আজকে কোনো সম্পদ বিক্রি করছি, তার মানে আগামী ১০ বছরে ওই সম্পদ থেকে যা আয় আসবে, তা আমি আজকেই হাতে পেয়ে যাচ্ছি। তাই আমাদের কাছে সব সম্পদই বিক্রিযোগ্য।’

গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপনি যে খাতে ব্যবসা করবেন, সে খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখেই আপনার ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হবে। এটাই নিয়ম। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশি প্রবৃদ্ধি করতে চাইলে দুটি উপায় আছে। প্রথমটি অসততার পথ বেছে নেওয়া আর দ্বিতীয়টি সম্পদ বেচাকেনার মাধ্যমে বেশি সম্পদ তৈরি করা। আমরা বেশি হারে প্রবৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় উপায়টি বেছে নিয়েছি, তাতে সফলও হয়েছি।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: সব উদ্যোক্তাকে একসঙ্গে পেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, এ গ্রুপকে কোথায় নিয়ে যেতে চান? জবাবে প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তারা বললেন, সন্তানদের হাতে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়েছি। শুধু তাদের বলেছি, কিছু মূল্যবোধের সঙ্গে কখনো সমঝোতা করা যাবে না। ব্যবসায় কখনো কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা যাবে না। যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। ব্যাংকঋণনির্ভর ব্যবসা থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে।

দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবসার হাল ধরা মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ বলেন, ‘গ্রুপের বিনিয়োগের ৯৫ শতাংশ অর্থই আমরা গ্রুপেই ফিরিয়ে আনব। বাকিটা মুনাফা হিসেবে বিতরণ হবে। ফেরত আনা অর্থ নতুন নতুন ব্যবসায় পুনর্বিনিয়োগ করা হবে। এর বাইরে কিছু অর্থ ট্রাস্টের মাধ্যমে সামাজিক কাজে ব্যয় করা হবে। তিনি জানালেন, এবার ট্রাস্টের বাজেট হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা।

অবকাঠামো খাতে বড় বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা ও ইচ্ছা রয়েছে বলে জানান মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ। তারই অংশ হিসেবে বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকা–জামালপুর রেলসেবা চালুর একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

গ্রুপের অধীনে যত কোম্পানি: ইউনাইটেড গ্রুপের অধীনে সব মিলিয়ে ৩৮টি কোম্পানি রয়েছে। যেগুলোর প্রায় সব কটি লাভজনক। লাভ করলেও ইউনাইটেড নার্সিং কলেজ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনাইটেড মক্কা–মদিনা ট্রাভেল অ্যাসিস্ট্যান্স কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা নেয় না প্রতিষ্ঠানটি। ভবিষ্যতেও এসব কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা গ্রুপের হিসাবে নেওয়া হবে না বলে জানান। সূত্র: প্রথম আলো

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে