বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২০, ০৭:১৯:৩৮

বাচ্ছারা সম্প্রদায় : যে সম্প্রদায়ে পতিতাবৃত্তিই ঐতিহ্য

বাচ্ছারা সম্প্রদায় : যে সম্প্রদায়ে পতিতাবৃত্তিই ঐতিহ্য

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ভারতে এখনও বেশিরভাগ পরিবারে মেয়ে সন্তানের চাইতে ছেলে সন্তানদের বেশি পছন্দ করে। কিন্তু যখন হিনা জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার বাবা-মা রীতিমত উৎসব উদযাপন করেছিলেন। দু'র্ভা'গ্যবশত, এই উদযাপনের পেছনে ছিল বিচিত্র একটি উদ্দেশ্য।

হিনা দেশটির প'শ্চাৎপ'দ বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। এই সম্প্রদায়ে শত শত বছর ধরে এখন পর্যন্ত একটি প্রথা প্রচলিত আছে। যেখানে সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের পরিবারে জন্ম নেয়া সবচেয়ে বড় মেয়েকে পতি'তাবৃ'ত্তির দিকে ঠেলে দেয়। আর এই পতিতা বাণিজ্য শুরু হয় মেয়ের মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই।

পরিবারের পুরুষ সদস্য থেকে শুরু করে বাকি সবার জীবন ওইটুকু মেয়ের আয়ের ওপরই নির্ভর করে। কয়েকটি ক্ষেত্রে মেয়েটির আপন বাবা অথবা ভাই দা'লাল হিসেবে কাজ করে। যখন এই মেয়েটির বয়স হয়ে যায়, তখন তার স্থলে জায়গা করে নেয় তারই ছোট বোন।

এভাবেই এই প্রথা সম্প্রদায়ের সবার গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পালন হয়ে আসছে। এই সম্প্রদায়ে বিয়েটাও হয় ভিন্নভাবে। এখানে বিয়ে দেয়ার সময় কনের পরিবার বরের পরিবারের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ দাবি করে। যেটাকে অনেকেই উ'ল্টো যৌতুক হিসেবে আখ্যা দেন।

হিনাকে জন্মের পর থেকে এই ধরণের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং তারপরে খুব অল্প বয়সেই তাকে এই কাজে জো'রপূ'র্বক ঠেলে দেয়া হয়। তিনি বলেন, "আমাকে যখন এই পেশায় ঠেলে দেয়া হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আমাকে আমার মা ও নানীর দেখানো পথেই চলতে হয়েছে।"

প্রতিদিন তার কাছে গ্রামীণ ধনী থেকে শুরু করে ট্রাক চালক পর্যন্ত একাধিক খদ্দের আসতো। "১৮ বছর বয়সে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার সাথে কত অ'ন্যা'য় হয়েছে এবং ভী'ষণ রা'গও হয়েছিল তখন। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কি-ই বা করার ছিল? যদি আমি এভাবে উপার্জন না করতাম তাহলে আমার পরিবার কীভাবে বাঁচত?"

ভারতের বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত ভী'ষণ দা'রি'দ্র্যপী'ড়িত। পরিবারের জন্য উপার্জন এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তারা নারী সদস্যদের ওপর নির্ভর করে। স্থানীয় এনজিওর সমন্বয়ক আকাশ চৌহানের মতে, "এই পেশার আসা এক তৃতীয়াংশের বেশি মেয়ে বয়সে অনেক ছোট।"

বাচ্ছারা, একসময় যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠী ছিল। পরে তারা কেন্দ্রীয় রাজ্য মধ্য প্রদেশের তিনটি জেলায় ছড়িয়ে যায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা বা মহাসড়কের পাশে থাকে, যেখানে ট্রাক ড্রাইভাররা বিরতি নিয়ে থাকে।

অল্প বয়সী মেয়েরা, যারা কিনা স্থানীয়ভাবে "খেলোয়াড়" হিসাবে পরিচিত, তারা দলবেঁধে না হলে একলা একলাই গ্রাহকদের অনুরোধ করার জন্য অপেক্ষা করে। এছাড়া পথের দুই পাশে প্রায়শই ছোট দোকানের মত বুথ থাকে, সেখানে মেয়েটির দা'লাল হিসেবে তার ভাই না হলে বাবা, খদ্দেরকে নিমন্ত্রণ জানায়।

তারা চালকদের সাথে একটি চুক্তি করে, যা সাধারণত গ্রাহক প্রতি ১০০ থেকে ২০০ ভারতীয় রুপি হয়ে থাকে। ডলারের হিসাবে সেটা দেড় থেকে তিন ডলারেরও কম। স্থানীয়দের মতে, একটি কুমারী মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়া যায়। খদ্দের প্রতি সেটা পাঁচ হাজার রুপি বা ৭২ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এ নিয়ে হিনা বলেন, "প্রতিদিন, দিনের বেলা প্রায় চার থেকে পাঁচজন পুরুষ আসে। রাতের বেলা, আমরা হোটেল বা কাছাকাছি অন্য কোথাও যাই। সবসময় সং'ক্র'মিত রোগে ভো'গার ঝুঁ'কি ছিল," দ্য হিন্দু নামে ভারতের একটি জাতীয় পত্রিকা ২০০০ সালে এই ধরনের চিকিৎসার অ'বহে'লার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদন করে।

তারা জানিয়েছে যে এই সম্প্রদায়ের সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্যকে পাওয়া গেছে যারা কিনা এইচআইভি পজিটিভ। শতাংশের হিসাবে এই আ'ক্রা'ন্তের হা'র সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার ১৫%। এসব খেলোয়াড়দের অনেক মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই পেশায় আসায় কয়েক বছরের মাথায় হিনা একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়।

মা হওয়ার পরও তাকে আরও বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য চা'প দেয়া হতো। "অনেক মেয়েরা এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লেও তাদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হয়, সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য আরও অর্থ উপার্জন করতে চা'প দেয়া হয় তাদের," জানান হিনা। একজন যৌ'নক'র্মী হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে সে তার সম্প্রদায়ের মধ্যে কাউকে বিয়ে করার জন্য নি'ষি'দ্ধ হয়ে যায়। 

অবশেষে, হিনা স্থানীয় এনজিও'র সহায়তায় এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। "এই জ'ঘ'ন্য প্রথার মধ্য দিয়ে যে মেয়েটি যায়, শুধুমাত্র সেই, এই সং'গ্রা'মটা বুঝতে পারে। আমি জানি এটার অনু'ভূতিটা কেমন। তাই এই প্রথা চি'রত'রে উ'পড়ে দিতে আমি সহায়তা করে যাব।"

সামাজিকভাবে অনুমোদিত এই প্রথার উৎস নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। তাদের মধ্যে একজন জানায়, কিভাবে ন'রমে'ডিক উপজাতিদের বাহি'রাগত হিসেবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সং'গ্রা'ম করতে হয়েছিল। পরে তারা এই যৌ'ন বাণিজ্যকে দরি'দ্রতা কা'টিয়ে ওঠার উপায় বলে মনে করতে থাকে।

ভারতে মেয়ের চাইতে ছেলে সন্তান পাওয়ার আ'কা'ঙ্ক্ষা থাকায় দেশটিতে লি'ঙ্গের অনুপাতে ভ'য়াব'হ অসা'মঞ্জ'স্যতা দেখা যায়। কিন্তু বাচ্ছারা সম্প্রদায়ে এই সম'স্যাটি পুরোই উ'ল্টো। আকাশ চৌহান বলেন, "এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৩ হাজার সদস্য রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৬৫% নারী।"

বেশি সংখ্যক নারী হওয়ার একটি কারণ হল এই অঞ্চলে অল্প বয়সী মেয়েদের অ'বৈ'ধভাবে পা'চার করা হয়। পুলিশ সুপার মনোজ কুমার সিং জানান, গত কয়েক মাসে আমরা এই এলাকা থেকে প্রায় ৫০টি মেয়েকে উ'দ্ধা'র করেছি। এমনকি আমরা দুই বছর বয়সী একটি মেয়েকেও খুঁ'জে পাই। তাকে এখন একটি শে'ল্টার হোমে পাঠানো হয়েছে।"

মনোজ বলেন, তারা ঘন ঘন এ ধরণের আ'ক্র'মণ চালান কিন্তু গভীরভাবে প্রোথিত এই প্রথা শুধুমাত্র সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই শেষ করা সম্ভব। এই প্রথার মধ্যে থেকে অনেকেই সন্তান ধারণ করেন। এবং মেয়ে সন্তান হলে তার ভাগ্যেও এমন পরি'ণতি হয়।

মধ্যপ্রদেশের, যেখানে এই সম্প্রদায় বসবাস করে, সম্প্রতি একটি আইন পাস করে যেখানে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধ'র্ষ'ণের অ'ভিযো'গে মৃ'ত্যুদ'ণ্ডের বিধান রাখা হয়। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কেউ, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের সাথে যৌ'ন সম্পর্ক করলে তাদের কা'রাদ'ণ্ড বাড়ানো হয়েছে। ভারতে সম্মতির জন্য ন্যূনতম বৈধ বয়স ১৮ বছর ধরা হয়। কিন্তু এই ধরনের প'দক্ষে'প পরি'স্থিতি পরিবর্তন আনতে পারেনি।

বাচ্ছারাসদের এই পতি'তাবৃত্তির প্রথা পরি'হারের উদ্দেশ্যে ১৯৯৩ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এটি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা রাজেন্দ্র মহাজন বলেন, "প্রতি বছর আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য অলা'ভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দে'শ্যে প্রতিবছর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের মা'নদ'ণ্ডগুলো পূরণ করতে পারে নি।"

জাবালি নামের এই প্রকল্পটি মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে এই নারীদের পু'নর্বা'সনের উপর জো'র দেবে। এতে সরকারের সাহায্যসহ বা ছাড়া, পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলেও আসছে। এখন সম্প্রদায়ের অনেক অল্পবয়সী মেয়ে এই প্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্যত্র চাকরি খুঁ'জে নিচ্ছেন বা আরও শিক্ষা গ্রহণ করছে। এছাড়া স্থানীয় কিছু উদ্যোগও সাহায্য প্রদান করছে।

হিনাও এখন এ ধরণের উদ্যোগের একটি অংশ- এই উদ্যোগের আওতায় তাকে ২০১৬ সালে উদ্ধার করা হয়েছিল। হিনা বলেন, "আমি অন্যান্য মেয়েদের বোঝাই যে তারা এখানে এলে সাহায্য পাবে এবং এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আমি এজন্য আমার সাধ্যমত যা পারি, করব।"

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে