শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০২০, ০৯:৫২:৩০

‘খাবার কিনতে গিয়ে মা আর ফেরেনি’

‘খাবার কিনতে গিয়ে মা আর ফেরেনি’

দিনাজপুর: “মা বলেছিল, ‘বাবা এখানে থাক আমি খাবার নিয়ে আইতাছি। একদম ছো'টাছু'টি করবি না, বসে থাক। আমি যাব আর আসব।’ সেই মা ৪ বছর হয়ে গেলো আসেননি। আমি মায়ের কথা শুনেছি, এই স্টেশনেই পড়ে আছি। কত খুঁ'জে'ছি, মার দেখা আর পা'ইনি।”

এটা সিনেমার গল্প নয়, ৮ বছর বয়সী এক কিশোরের জীবনের গল্প। ছেলেটির নাম আকাশ। দিনাজপুর রেলস্টেশন তার একমাত্র ঠিকানা। ৪ বছর আগে খাবার কিনতে যাওয়ার ছ'লনা করে অন্য পুরুষের হাত ধ'রে চলে গেছেন মা, আর দেখা মেলেনি। বাবা থেকেও নেই। আকাশকে একদম স'হ্য করতে পারেন না তিনি। তাকে ছেলে হিসেবে মেনে নিতে চান না। পা'রলে গা'য়ে হাত তু'লে। নতুন বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার পেতে সুখেই আছেন বাবা।

আকাশের একমাত্র আপনজন বৃদ্ধা নানি। দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় থাকেন তিনি, কিন্তু নিজেরই মু'মূ'র্ষু অব'স্থা। তার সাথেও কোনো যোগাযোগ নেই। সেই নানি বেঁচে আছে, না ম'রে গেছে তাও জানে না আকাশ। ‘আমি এত ছোট, আমি কি এত দূ'র যেতে পারি?’

সকালে ১০ টাকার ডাল পরোটা, আর রাতে ২০ টাকার সবজী-ভাত এই তার খাবারের তালিকা। এতেই তার সুখ। সেটাও কোনো কোনো দিন জু'টে না। কারণ সামান্য এই ৩০ টাকা জোগাতে তাকে যে ৩০ জনেরও বেশি মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। ‘কেউ দেয়, কেউ দেয় না। আবার ভালো মানুষেরা বেশি দেয়। গল্প করে’, বলে সে।

টাকা সে জমায় না, জমিয়ে কোথায় রাখবে! যা করবে তাও জানে না। তাই ৩০ টাকা জোগাড় কর‍তে পারলে সেদিন আর কোনো টে'নশ'ন নাই। আর কারো কাছে টাকা চায় না। এত টাকা দিয়ে কী করবে সে! ৩০ টাকাই তার প্রতি দিনের স্বপ্ন।

বলতে গেলে ট্রেনই তার সবথেকে আপন। ট্রেনের সাথে নি'বি'ড় স'খ্য'তা, মনের সুখে ট্রেনের এ-বগি ও-বগি ঘু'রে বেড়ানোতেই তার বিশ্ব ভ্রমণের সুখ। ঘুমাতে যাওয়া আর ঘুম থেকে তুলে দেওয়া সব কাজই করে ট্রেন। রাতে ঢাকাগামী ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর প্ল্যাটফর্ম যখন সম্পূর্ণ ফাঁ'কা আর নি'স্ত'ব্ধ হয়ে যায়, তখন সে ঘুমায়। আর সেই ঘুম ভা'ঙে ওই সকালে ট্রেনের হু'ইসে'লে। অভিভাবকহী'ন আকাশের ট্রেনই যেন একমাত্র অভিভাবক। আকাশের সব চেয়ে ভালো লাগে চাঁদ। ‘কী সুন্দর জ্ব'লে! আর সকালে জ্ব'লে সূর্য।’

অবুঝ এই ছেলের জীবন-জীবিকা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। যেভাবেই যাক যেন দিনটা কে'টে যায়। তবে, শুধু দিন যে কেটে যায় তা নয়, জীবন নামের অভি'জ্ঞতার ঝু'ড়িটাকেও ভা'রী করে দেয়। শুধু তার নিজ'স্ব একটা ঠিকানা হয় না। আপন বলে কেউ রয়ে যায় না। সমস্ত কিছু যেন হা'রিয়ে যায়। কোনো একজন গত শীতে বু'ট জুতা, মোটা জ্যাকেট আর স্যুট (ফুল পান্ট) কিনে দিয়েছিল। সেগুলোও হা'রিয়ে গেছে। তার প্রশ্ন ‘আমার সব কিছু খালি হা'রায় যায় কেন?’

এখন তার সম্বল শুধু পরনের বিব'র্ণ হাফ পান্ট, ময়লা টি-শার্ট আর এক জোড়া বার্মিজ সেন্ডেল।

কিন্তু আকাশ কী হা'রিয়ে ফেলে, নাকি আপনা আপনি সব কিছু হা'রিয়ে যায়? এই ৮ বছরের জীবনে সব থেকে বড় হা'রা'নো বিষয়বস্তু তার পরিচয়টা, সাথে বাবা-মায়ের নাম। কারণ, আকাশের জ'ন্ম নিবন্ধন কার্ড হয়নি। তাই, স্কুলের বেঞ্চে কোনো দিন বসার অনুমতি পায়নি সে। জন্ম নিবন্ধন ছাড়া কোনো স্কুলে ভর্তি নেয়নি তাকে।

তবে সে আরবি হরফ জানে। মায়ের কাছে থাকতে ম'ক্ত'বে গিয়েছিল। সবকটা হরফ এক নি'শ্বা'সে বলতে পারে, এটাই তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। আকাশ চাই বড় হয়ে পুলিশ হবে। এই যোগ্যতায় আকাশের পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন কি পূরন হবে? কে নেবে আকাশের স্বপ্ন পূরণের?

হয়তো স্বপ্নটাও তাকে রেখে হা'রিয়ে যাবে। কিন্তু এত সব অপ্রা'প্তির ভি'ড়েও তার নাকি কোনো ক'ষ্ট নেই। শুধু মানুষ গায়ে হাত তু'ললে, আর মাকে কেউ গা'লাগা'ল দিলে আকাশের মন খা'রা'প হয়ে যায়। তখন ভী'ষণ কা'ন্না পায়। একা একা কাঁ'দে ও। আর মা-বাবার কাছে তার প্রশ্ন, ‘আমার কি কোনো দো'ষ ছিল?’

সূ'ত্র : রাইজিংবিডি, লেখক: শিক্ষার্থী, অ্যাগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি)।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে