মৃত্যু পরোয়ানা লুকিয়ে দু’চাকায় দুনিয়া!
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : দেশের সংখ্যা ১৯১টি। পথ ২ লাখ কিলোমিটার। ২০ মিলিয়ন মানুষ৷ বাইসাইকেল মাত্র একটি৷ এক বাঙালি যুবক৷ সাইকেল চেপে দুনিয়া ঘুরছেন এক বঙ্গসন্তান৷ লক্ষ্য, এইডস সচেতনতা বৃদ্ধি৷
২০০৪-এ যাত্রা শুরু করে ১১ বছরে ১১৪টি দেশ পাড়ি দিয়েছেন বাসন্তীর বছর বত্রিশের যুবক সোমেন দেবনাথ৷ কয়েক বছর আগের কথা৷ বরফের চাদরে ঢাকা ময়দান৷ যেদিকে নজর যায় শুধুই বরফ আর বরফ৷
থার্মোমিটারে তাপমাত্রার পারদ ৪৫ ডিগ্রি৷ খোলা আকাশের নিচে পাতা একটা স্লিপিং ব্যাগ কেঁপে উঠল ধীরে৷ মাথা বের করে সোজা তাকালেন এক যুবক৷ ঘাড় ছাপানো চুল ছুঁয়ে গেল বরফের স্তর৷ ঘড়ির কাঁটায় রাত৷ কিন্ত্ত চারদিক দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল৷
জায়গাটার নাম গ্রিনল্যান্ড৷ চোখ জুড়োনো আলোর নাম নর্দার্ন লাইট৷ যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেক বাঙালি, সেখানেই বেশ কিছুদিন থেকে এস্কিমোদের এইডস সচেতনতার পাঠ দিয়েছেন সোমেন৷ শান্ত-নিরীহ মানুষগুলোর সঙ্গে ঘুরে শিকার করার সময় বুঝিয়েছেন, এইচআইভি- এই তিনটি অক্ষরের মধ্যে ঠিক কতটা কঠিন মৃত্যুর পরোয়ানা লুকিয়ে৷
সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরোনো অখ্যাত এক মফস্সলের ছেলেটাকে আপন করে নিয়েছিলেন এস্কিমোরা৷ সাধের ইগলুতে থাকতেও দিয়েছিলেন সযত্নে৷ ঠিক যেমনটা করেছিলেন দোহার ভারতীয়রাও৷ সোমেনের অভিজ্ঞতার তালিকায় এসব অবশ্য 'টিপ অফ দ্য আইসবার্গ'৷
সালটা ২০০৪৷ সদ্য জুলজি অনার্স পাস করে বাসন্তী বাজার লাগোয়া কাপড়ের ব্যবসায়ী পরিবারের বড় ছেলে সোমেন বাড়িতে জানিয়ে দেন , সাইকেল চেপে বিশ্বভ্রমণ করবেন৷ লক্ষ্য তার, এইডস সচেতনতা৷ এইচআইভি নিয়ে সোমেনের পড়াশোনার শুরুটা অবশ্য তারও বছর সাতেক আগে৷
খবরের কাগজে এইডস আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পড়ার পর থেকেই৷ বইপত্তর ঘেঁটে রোগটা সম্পর্কে জানার পর স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির কাছ থেকে তালিম নিয়ে সুন্দরবনসহ দক্ষিণ ২৪ পরগনায় কাজ শুরু করেছিলেন সোমেন৷ অল্প সময়ের মধ্যেই বোঝেন, জেলার গণ্ডিতে থেমে থাকলে হবে না৷
বিশ্বের দরবারে পৌঁছতে হবে৷ বাড়িতে কথাটা পাড়তেই বাবা রামমোহন দেবনাথ জানিয়ে দেন, 'গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতেই হবে৷ তারপর যা কিছু৷ বাবার কথা রেখেছিলেন সোমেন৷ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার দু'দিনের মাথায় ২০০৪ সালের ২৭ মে সাইকেল নিয়ে অজানা দেশের পথে পাড়ি দেন এইডসে সচেতনতা প্রসারে৷
তিন বন্ধুর সঙ্গে জোট বেঁধে ত্রিশের দশকে দু'চাকাকে সঙ্গী করে ঘর ছেড়েছিলেন বিমল মুখুজ্জে৷ তার বিশ্বজয়ের কাহিনী 'দু'চাকায় দুনিয়া ' স্বর্ণাক্ষরে খঁচিত৷ কিন্ত্ত আপনার ঘরের ছেলে তো একা পাড়ি দিল৷ বুক কাঁপল না?
সোনারপুরে মেজ ছেলের ফ্ল্যাটে বসে ছিলেন সোমেনের মা পঞ্চাশোর্ধ্ব শোভা দেবনাথ৷ গলা ধরে এল নিমিষের মধ্যে৷ বলে উঠলেন, আমি আটকে রাখলে হয়তো ও থাকতো৷ কিন্ত্ত মনে কষ্ট পেত৷ ও যে উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছে সেটা তো আর কম নয়৷ ক'জন পারে অমনি সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যেতে?
ও পেরেছে৷ তাই আটকে রাখাটা সঙ্গত মনে করিনি৷ যাত্রাপথের প্রথম ভাগটা যতটা কঠিন ছিল সোমেনের জন্য, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি তার পরিবারের জন্য৷ শোভাদেবীর কথায়, এখন তো ইন্টারনেট এসেছে৷ চোখের সামনে দেখতে পারি৷ ফোনে কথা বলতে পারি৷ আগে তো তিনমাস -চার -পাঁচমাস অন্তর কথা হত৷ কখনো তা-ও হত না৷
চিঠি আসতো৷ যতদিন হাতে চিঠিটা পেতাম না প্রাণটা আটকে থাকতো৷ ঠাকুরকে ডাকতাম শুধু৷ এরই মধ্যে দেশে পিঠোপিঠি মেজভাইয়ের বিয়ে হয়েছে৷ তার ছেলেও হয়েছে৷
যার বয়স এখন ৭৷ সে সব কিছু অবশ্য চাক্ষুষ করতে পারেননি সোমেন৷ কিন্ত্ত তাতে কী? গত ১১ বছরে ১১৪ দেশের ২৬ জন রাষ্ট্রপতি, ৫৬ জন প্রধানমন্ত্রী, ২১৮ জন মন্ত্রী, ১০৫ জন ভারতীয় হাইকমিশনার আর অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি৷
শিখেছেন এইডস সচেতনতার নতুন কোনো পাঠ৷ তাদের শিখিয়েছেনও৷ নতুন বছরের প্রাক্কালে ঘানায় বসে টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে জানালেন, স্বামী বিবেকানন্দ আর বিমল মুখোপাধ্যায়কে আইডল করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ সঙ্গে ছিল, একটা টেন্ট আর খাওয়ার কিছু জিনিস৷
তালেবানদের হাতে ধরা পড়েছি৷ সিরিয়ায় একটুর জন্য বোমার আঘাত থেকে বেঁচেছি৷ জারোয়াদের সঙ্গে অনেকদিন কাটিয়েছি৷ ডাকাতদের মুখে পড়েছি৷ কিন্ত্ত সব মিলিয়ে যা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছি, তা অমূল্য৷ বিশ্বজয়ের জন্য ভিসার বন্দোবস্ত, অর্থের জোগান, সেসব হলো কীভাবে?
সোমেনবাবুর কথায়, 'প্রত্যেক দেশের ভারতীয় হাইকমিশন আমাকে ভিসার ব্যাপারে সাহায্য করেছে৷ আর যে দেশে গিয়েছি, সেখানকার সাধারণ মানুষ আমার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে অর্থ সাহায্য করেছেন৷ শুধু এইচআইভি সচেতনতাই নয়, সোমেন এখন অর্থ জোগাড় করছেন তার স্বপ্নের 'গ্লোবাল ভিলেজ তৈরির লক্ষ্যে৷
কী সেই গ্লোবাল ভিলেজ? 'বিশ্বের সব দেশের মানুষদের জন্য একটা আস্তানা৷ যেখানে দেখের কোনো গন্ডি থাকবে না৷ ২০২০ তে দেশে ফিরে সেটাই করতে চাই প্রথমে, জানান সোমেন৷ আর তাই এখন থেকেই যা অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন তার ৬০ ভাগ জমাচ্ছেন সোমেন৷ নিজের একটি ওয়েবসাইটও খুলেছেন তিনি৷
শুক্রবার সকালে যখন বিশ্বের সব মানুষ নতুন বছরের আনন্দ সেলিব্রেট করছেন, তখন সোমেনের পাড়ি পরের গন্তব্য সেনেগালে৷ সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
১ জানুয়ারি,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম
�