ছেলের সাথে বাবা-মা একই ক্লাসের শিক্ষার্থী
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : গ্রামের পিচঢালা রাস্তা ধরে পাশাপাশি স্কুলে যাচ্ছে তিনটি সাইকেল। একাদশ শ্রেণির তিন সহপাঠী হলেন বাবা, মা আর ছেলে! প্রতিদিনের এই চিত্র দেখতে ভিড় জমান অনেকে। এতে সড়গড় হয়ে উঠেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার হাঁসখালির মামজোয়ান গ্রাম।
বাবা বলরাম মণ্ডল। পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে সেই ছেলেবেলায়। রুটি-রুজির জন্য স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় স্ত্রী কল্যাণীর। ফলে পড়াশোনায় ইতি ঘটে। মাধ্যমিক পাশ করা হয়নি। পড়াশোনার ইচ্ছেটা তবুও কোথায় যেন ‘ঘুন পোতার মতো’ তাড়া করত তাঁদের।
চল্লিশের মাঝা মাঝি বয়সে পৌছে মণ্ডল দম্পতি তাই রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেন বছর দুয়েক আগে। এ বছর ছেলে বিপ্লবের সঙ্গে তাঁরা তিন জনেই উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রী।
নদিয়ার ধানতলার আড়ংঘাটা হাজরাপুর হাইস্কুলে কলা বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন তারা। বিষয় বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, শিক্ষাবিজ্ঞান এবং ইতিহাস। স্কুল বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। বলরাম মন্ডল বলেন, পড়া আর হয়ে ওঠেনি। তবে কষ্টটা ঘুন পোকার মতো তাড়িয়ে বেড়াতো জানেন।’ তিনি বলেন, আগের চেয়ে আর্থিক অবস্থা একটু ফিরেছে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে শেষতক তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এক সঙ্গে পড়ব।’’ চাষের কাজ মিটিয়ে স্কুলের পথ ধরেন তিনি। কল্যাণীদেবীও সংসারের পাঁচটা কাজ সামলে, হেঁশেল টেনে তার পর পা রাখেন সাইকেলের প্যাডেলে। কল্যাণী জানান, পড়ার ইচ্ছে রয়ে গিয়েছে তাঁরও। এ বার তাই এক সঙ্গে ফের নতুন করে শুরু করেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, সংসারে তিনটি মাত্র মানুষ। তিন জনেই স্কুলে থাকি। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে তবে খাওয়া। তবু কী যে তৃপ্তি বলে বোঝাতে পারব না!
তাঁদের পড়শিরাও এ ব্যাপারে বেশ সহমর্মী। পাশে রয়েছেন শিক্ষকেরাও। বলরাম বলেন, স্যারেরা সব সময় উৎসাহ দেন। অসুবিধা হচ্ছে কিনা, খোঁজ নেন। তাঁদের মুখ চেয়ে ভাল করে পাশ করতেই হবে। রাতে সপরিবারে পড়তে বসেন তাঁরা। পড়া বুঝতে অসুবিধে হলে সহায় ছেলে বিপ্লব। বিপ্লবের তিন গৃহশিক্ষকও মা-বাবাকে সাহায্যা করেন।
বাবা-মার সঙ্গে স্কুলে যেতে কেমন লাগে বিপ্লবের? আনন্দবাজারকে সে জানায়, একই ক্লাসে পড়ায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও বিষয় আলোচনা করে পড়লে সহজে পড়া বোঝা যায়। স্কুলে এসে বয়সের ব্যবধান ভুলে যান মণ্ডল-দম্পতি। সহপাঠী সুপ্রিয়া বিশ্বাসের কথায়, তারা নিজেদের মতো লেখাপড়া করেন। আমাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন। পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে জিজ্ঞাসা করেন। কোনও বাধা নেই।
আড়ংঘাটা স্টেশন থেকে সাড়ে আট কিলোমিটার দূরে চূর্নী নদীর কাছে হাজরাপুর হাইস্কুল। এখানে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় আটশো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার হোতা বলছেন, ওই দম্পতি ছেলেকে ভর্তি করাতে এসেছিলেন। কিন্তু, তাদের পড়ার আগ্রহ দেখে ভর্তি করে নিয়েছি। এখন দেখছি সে দিনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।
স্কুলের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, ছেলের সঙ্গে বাবা-মায়ের প্রতিযোগিতাও রয়েছে বেশ। পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে থাকলেও ছেলেকে বার্ষিক পরীক্ষার নম্বরে ছেলেকে পিছনে ফেলতে চান বলরামবাবু। তাঁরা জানাচ্ছেন, পড়া ধরলে এক সঙ্গেই হাত তোলেন ওঁরা। যা শুনে কল্যাণীদেবী বলছেন, দেখি না, কে বেশি নম্বর পায়, বাবা ছেলে নাকি আমি!
০৯ জানুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএস
�
