বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১, ০৩:২০:১৫

উড়ন্ত বিমানের চাকা আঁকড়ে বেঁচেছিলেন প্রদীপ সাইনি!

 উড়ন্ত বিমানের চাকা আঁকড়ে বেঁচেছিলেন প্রদীপ সাইনি!

বিমানের চাকা আঁকড়ে আকাশে ওড়া হয়তো সম্ভব। তবে সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে কপালজোর লাগে। চাকা-লগ্ন  সেই সফর নাকি বেশ যন্ত্রণাদায়কও। 

আফগানিস্তানে সম্প্রতি এ ভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন দু’জন। পারেননি। উড়ন্ত বিমান থেকে তাঁদের মাটিতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন নিদারুণ ভয়ে তাঁদের বুক কেঁপে উঠেছে। 

বিমানের ভিতরে জায়গা ছিল না। তাই চাকা ধরেই তালিবান কব্জায় থাকা আফগানিস্তান থেকে পালাতে চেয়েছিলেন ওই দুই আফগান। কিন্তু  বিমানটি আকাশে ওড়ার খানিক ক্ষণের মধ্যেই তাঁরা পড়ে যান।  বিমান থেকে একে একে কালো বিন্দুর মতো মানুষের খসে পড়ার  অমন দৃশ্য এর আগে দেখা যায়নি। 

আপাত দৃষ্টিতে বিমানের চাকা ধরে পালানোর চেষ্টাকে অস্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। তবে বাঁচার এমন মরিয়া চেষ্টা কাবুলেই প্রথম হল না। এর আগেও পৃথিবীর বহু দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে।

কতবার? তার একটা হিসেব আমেরিকার ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে রয়েছে। সংখ্যাটা তাক লাগানোর মতো। আমেরিকার উড়ান সংস্থাটির কথা মতো, ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এ ধরনের ১১৩টি ঘটনার হিসেব রয়েছে তাদের কাছে। কাবুলেরটি সেই হিসেবে ১১৪তম।

পালাতে মরিয়া দুই আফগান বিমানের চাকার ফোকর বা হুইল ওয়েলে লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন । এই হুইল ওয়েল আসলে বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার কম্পার্টমেন্ট। সেখানে লুকিয়ে সফর করার ঘটনার একটি পোশাকি নামও আছে— ‘স্টো অ্যাওয়ে’। যার আক্ষরিক অর্থ গা ঢাকা দিয়ে সফর করা।

উড়ান সংস্থাটি জানাচ্ছে, শুধু কাবুল নয় এর আগেও ১১৩টি ‘স্টো অ্যাওয়ে’র ঘটনা ঘটেছে। তবে তার মধ্যে অধিকাংশই ব্যার্থ । এই ধরনের সফর করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন ৮৬ জন।

 বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে বিমান থেকে পড়ে গিয়েই। যেমনটা হয়েছে কাবুলে। বাকিরা যারা কোনওমতে বেঁচে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন, তাঁদের অনেকেই অবতরণের সময় চাকার তলায় পিষে মারা যান। কেউ আবার বেশি উচ্চতায় বাতাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণে, অক্সিজেনের অভাব এবং তীব্র ঠান্ডাতেও মারা যান।

অবশ্য এমন সফরে খুব অল্প সংখ্যায় হলেও বেঁচে গিয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন। এঁদের মধ্যে একজন ভারতীয়। নাম প্রদীপ সাইনি। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে প্রদীপ এবং তাঁর ছোট ভাই বিজয় গোপনে উঠে বসেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৭ বিমানের চাকার ফোকরে। নয়াদিল্লি থেকে বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে যাচ্ছিল।

পঞ্জাবের গাড়ি মেকানিক প্রদীপের বয়স তখন ২২। তাঁর ভাই বিজয় ১৮ বছরের তরুণ।দু’জনকেই শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। প্রাণের ভয়েই লন্ডনে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুই ভাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি।

হিথরোয় নামার আগেই ঠান্ডা জমে যাওয়া বিজয়ের দেহ প্লেন থেকে মাটিতে পড়ে যায়। পাশেই ছিলেন প্রদীপ। তিনি বেঁচে যান।

৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন দু’জন। এর উপর ওই উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাবও ছিল। পরে এক সাক্ষাৎকারে সফরের বর্ণনা দিয়ে প্রদীপ বলেছিলেন, ‘‘১০ ঘণ্টার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এখনও তাড়া করে আমাকে।’’।

হিথরোর রানওয়েতে পড়ে থাকা অবস্থায় প্রদীপকে উদ্ধার করেছিলেন বিমানবন্দরের কর্মীরা। যে চিকিৎসকরা তাঁকে দেখেছিলেন, তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রদীপকে বেঁচে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলেন তাঁরাও। পরে এর ব্যাখ্যাও মেলে। চিকিৎসকরা জানান টেক অফের কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রদীপের শরীর শীতঘুমে চলে গিয়েছিল। যে অবস্থায় জ্ঞান থাকলেও শরীর তার ন্যূনতম কাজটুকু চালায়। এ জন্যই অক্সিজেনের অভাব, তীব্র ঠান্ডা সহ্য করতে পেরেছিল শরীর।

তবে ওই সফর প্রদীপকে সবদিক থেকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। ছোট ভাইকে সামনে থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিলেন প্রদীপ। সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘‘যদি দু’জনেই মরে যেতাম তবে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু আমার ভাই ছিল আমার প্রিয় বন্ধু।’’ টানা ছ’ বছর হতাশায় ভুগেছিলেন প্রদীপ।

শারীরিক ভাবেও ধ্বস্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন শোনার সমস্যায় ভুগেছেন প্রদীপ। গাঁটের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতেন মাঝে মধ্যেই। প্রতিকূল বিমান সফরের লড়াকু যোদ্ধা। কর্মসূত্রে রোজ বিমান নিয়েই কাজ করতে হয় প্রদীপকে। তবু লন্ডনে তাঁর প্রথম বিমান সফরের কথা ভাবলে আজও ভয়ে কন্টকিত হন প্রদীপ।-আনন্দবাজার

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে