এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : লন্ডনের অনাথ আশ্রম থেকে বাবার খোঁজে পালিয়েছিল সতেরো বছরের রাম আর ম্যাথিয়াস৷ জাপান, ভারত ও ইউরোপের একাধিক দেশ ঘুরে বেড়ানোর সময় ভিন্ন মাত্রার (ডাইমেনশন ) ভিনগ্রহীদের সঙ্গে লড়তে লড়তে তা বদলে যায় অন্য এক অভিযানে৷ একের পর এক বাধা কাটিয়ে শুরু হয় তাদের 'ফাদার অফ দ্য গডস'-এর উৎসের খোঁজে নিরন্তর লড়াই৷ এ নিয়ে লিখেছেন সুদীপ্ত তরফদার।
যাত্রাপথে আদিম সভ্যতার অধুনা হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর অন্ধকার থেকে তাদের সামনে উঠে আসে এমন অনেক রহস্য, যা খুলে দেয় অন্য এক সভ্যতার সন্ধান৷ শুনতে আজগুবি লাগতে পারে৷ তবে যখন জানবেন উপরের সায়েন্স ফিকশন প্লটের লেখক অভিষেক রায়ের বয়স মাত্র পনেরো, তখন 'ডায়মেনশন' সিরিজের তিন পর্বের ফিকশনটির প্রথম পর্ব পড়ার জন্য কিছুটা আগ্রহ জাগতে বাধ্য!
বিজ্ঞানে আগ্রহী হলে আরো কিছুটা উত্সাহী হবেন, যখন জানবেন, দশম শ্রেণির এই ছাত্রের পাঠ্যক্রমের মধ্যে না থাকলেও বইয়ের প্লটে কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক পরা-অপরা বাস্তবের দুনিয়ায় তার সাবলীল বিচরণ রয়েছে কোয়ান্টাম ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথামেটিক্স এবং অ্যানসিয়েন্ট হিস্ট্রির একাধিক সভ্যতার মধ্যে৷
যেখানে 'গড' অপরা দুনিয়ার বদলে পরা-দুনিয়ারই বাসিন্দা, এক মানবিক শক্তি৷ যার উত্সের খোঁজে চলছে রাম-ম্যাথিয়াসের পাহাড়-পর্বত-জল-জঙ্গল ভেঙে অভিযান৷ চমকের শেষ নয় এখানেও৷ ১২ বছর থেকে বইটি লেখা শুরু করা অভিষেকের লেখার দুনিয়ায় হাতেখড়ি অবশ্য আরো আগে৷
স্প্যানিশসহ গোটা পাঁচেক ভাষায় সাবলীল ওবেরয় ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এই ছাত্র আমজনতার জন্য কোয়ান্টাম ফিজিক্স, জটিল ক্যালকুলাস ও থিওরি অফ রিলেটিভিটির গোটা তিনেক মেড-ইজি লিখে ফেলেছে, যা মোটেই তার বয়সোচিত সারল্যের সঙ্গে যায় না৷
আমেরিকা ও কানাডার পর মুম্বাই-বেঙ্গালুরু-দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে অভিষেকের বই৷ পাওয়া যাচ্ছে অ্যামাজন-ফ্লিপকার্টের মতো ই -কমার্স সাইটেও৷ এবার তার ৯৫ বছরের ঠাকুরদার শহর কলকাতার পালা৷ আজই বই প্রকাশ পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক স্টোরে৷ সেই উদ্দেশ্যে কলকাতায় আসা অধুনা মুম্বাইনিবাসী অভিষেককে পাওয়া গেল শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে ঘরোয়া আড্ডাতে৷
যাকে পাওয়া গেল, তার সঙ্গে মেলানো যাবে না এমন এক 'ড্রিমার'কে যে, ওর বয়সী আর পাঁচজনের মতো পড়াশোনার দুনিয়ায় হাবুডুবু না খেয়ে বরং উপরের ক্লাসের দাদাদের ধরে জানতে চায় ক্যালকুলাসের ডেরিভেশনের ফার্স্ট প্রিন্সিপ্যালটা কেন ও রকম৷ পরেরদিন মনের মতো উত্তর না পাওয়ায় নেটে টিউটোরিয়াল ঘেঁটে ঠিক খুঁজে নেয় ক্যালকুলাসের অন্দরের রহস্যকে৷
আমবাঙালির ঘরের ছেলেটার মতো ক্যারিয়ারের 'র্যাট রেসে' একমাত্র ছেলেকে নামিয়ে দিতে চান না জয়দীপ-বৈশালি৷ আর তাই পরিবারের অফুরন্ত উত্সাহ আর সুযোগ পেয়ে বই পড়ার মধ্যে নিজেকে আটকে না রেখে বিষয় পড়ে স্কুলে একাধিক ক্ষেত্রে 'স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার' নির্বাচিত হয়েছে স্বল্পভাষী এই কিশোর৷ তাও কোনো গৃহশিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই৷
'স্রেফ জানার জন্যই বিষয়টা নিয়ে পড়ে থাকি, খুঁজতে থাকি মনের মধ্যে জাগা প্রশ্নগুলোর উত্তর, বিষয়ের মধ্যের মারপ্যাঁচগুলো৷ না বোঝা পর্যন্ত থেমে যেতে পারি না', সরল স্বীকারোক্তি অন্ধকার আর মাকড়সায় ভয় পাওয়া কিশোর অভিষেকের৷ তা বলে এসব করতে গিয়ে মোটেই বয়সোচিত উচ্ছ্বলতা হারায়নি অভিষেক৷
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সায়েন্স ফিকশন দেখতে যাওয়াতেও কসুর করে না মুম্বাইয়ে স্কুলস্তরে সাঁতারে একাধিক সোনার পদকজয়ী এই কিশোর৷ স্রেফ শখে যে তবলা শিখতে শুরু করার পর সম্প্রতি রাজ্যস্তরের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক স্তরে 'স্পেলিং বি' কোয়ালিফায়ার অভিষেককে মহারাষ্ট্র সরকার তাদের ইন্টারমিডিয়েট স্তরের পরীক্ষায় 'এ' গ্রেড আর্টিস্টের মর্যাদাও দিয়েছে৷ আঁকাতেও সমান উত্সাহী অভিষেক স্রেফ শখে যা আঁকে, তাও ঈর্ষণীয়৷ মুম্বাইয়ে একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে তার আঁকার, একাধিক গোল্ড মেডেলও এসেছে ঝুলিতে৷
এত কিছু করার সময় পাও কখন? বিব্রত কিশোর জানায়, কখনও কোনো কিছুতে কিছু পেতেই হবে না ভেবে, ফার্স্ট-সেকেন্ডের ভাবনা ছেড়ে, নিজের ভালোবাসা থেকে বিষয়গুলি নিয়ে পড়ে থাকাই তার সাফল্যের রহস্য৷ জানার ইচ্ছাই ছুটিয়ে বেড়ায় তাকে৷ শোনার পর ভাবনা আসতে বাধ্য, স্রেফ শখ আর ইচ্ছা যদি পনেরোর কিশোরকে এত 'সাফল্য' দিতে পারে, তাহলে আমরা পারি না কেন?
আমাদের ঘরের বাচ্চার ওপর একইভাবে প্রতিযোগিতার ভূতকে সরিয়ে দিয়ে তাদের শৈশবকে ফিরিয়ে দিতে? সবাই এত 'ট্যালেন্টেড' হয় না, যুক্তি দেয়া যেতেই পারে৷ অভিষেককে দেখার পর সেখানে পাল্টা বলা যায়, নিজের চেষ্টায় গৃহশিক্ষক ছাড়াই যে অঙ্কে ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চ পরীক্ষায় দেশের মধ্যে প্রথম ৫০-এর মধ্যে রয়েছে, নাসার থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার জন্য যে নির্বাচিত হয়েছে, এসবই কি গুঁতিয়ে সম্ভব?
এগুলো না হয় গুঁতিয়ে করলেন, কীভাবে ব্যাখা করবেন, এতকিছু করার পরও যাকে বলে পুরোদস্ত্তর 'অ্যাকমপ্লিশড' ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার অভিষেককে বা পনেরোর এই কিশোরকে যে এর মধ্যেই সময়ের ফাঁক খুঁজে নিয়ে মুম্বাইয়ের ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টে রোবোটিক মেথড আবিষ্কার করে রাজ্যস্তরে পুরস্কৃত হয়েছে৷ তাই ক্যারিয়ারের 'র্যাট রেসে' না থেকে আইডল রিচার্ড পি ফেনিম্যান-এর মতো পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপক হতে চাওয়া আজকের 'লেখক' অভিষেক ওর প্রজন্মের বাকিদের কাছে পুরোদস্ত্তর রোলমডেল হতেই পারে তার নিজের সহজাত অনায়াস প্রতিভায়৷
খেলার ছলে অনেকেই লেখা শুরু করতে পারে৷ কিন্ত্ত সেটাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে ৩৭৬ পাতার বই লিখে ফেলা বা মনের স্লেটে তার পরবর্তী পর্বগুলোর প্লট ছকে ফেলা, এত অল্প বয়সে এই পরিণতি দেখানোর জন্য সত্যিই কুর্নিশ করতে হয় অভিষেকের প্রজ্ঞাকে৷ বই না পড়ে ভালোবেসে বিষয় পড়ে অন্যদের এর মধ্যেই অনেকটাে পেছনে ফেলে দিয়েছে অভিষেক৷ সূত্র : ইন্ডিয়ান টাইমস
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/