এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রস্তরযুগ থেকে আজকের স্কাইস্ক্রাপার। মানুষের আবাস অনেকটাই বদলে গেছে। কেউ কেউ সেটা আবার দু'মলাটে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে লিখছেন অনিরুদ্ধ ধর।
স্টিফেন হকিং যেমন 'ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম' লিখে নাম এবং টাকা কামিয়েছেন, টিম ল্যামবার্ট-এর ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি৷ যদিও তার 'ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হাউসেস' কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিংশ শতাব্দির শেষ পর্যন্ত মানুষের থাকার বসতবাড়ির চেহারা কীভাবে বদলেছে তার একটা রূপরেখা ধরার চেষ্টা করেছেন টিম ল্যামবার্ট৷
এমনকী এই বাড়ির অন্দর মহলের বিন্যাস, আসবাবের চেহারা সবকিছুর খুঁটিনাটি বর্ণনা তিনি রেখেছেন এ লেখায়৷ এবারের বিষয় টিম ল্যামবার্ট বর্ণিত বসত-বাড়ির বিবর্তন৷
তিনি লিখছেন, মানুষ যখন চাষ করতে শিখল, তখন তারা স্থায়ী আবাস গড়তেও শুরু করল৷ তখনই এল প্রথম আসবাব৷ ২০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে স্কটল্যান্ডের সারা ব্রায়ে নামের গ্রাম থেকে পাওয়া প্রস্তর যুগের আসবাবকেই তিনি ধরে নিচ্ছেন মানুষ সভ্যতার প্রাচীনতম আসবাবের প্রাপ্ত নমুনা হিসেবে৷
অর্থাত্ প্রস্তরযুগের প্রায় অবসানের আগে আর তেমন কোনো আসবাবের সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ তার মতে, 'প্রস্তর-যুগের কৃষি-জীবনে অভ্যস্থ মানুষেরা থাকতেন পাথরের তৈরি বাড়িতে, যার ছাদ তৈরি হতো বিশালাকৃতি মৃত পশুর চামড়া শুকিয়ে৷
বাড়ির ভেতরে বিছানা, টেবিল, কাবার্ড পর্যন্ত তৈরি হতো পাথর দিয়ে৷ সেই সব পাথুরের-বাড়ি এবং পাথুরে-আসবাবের ছবিও পাওয়া যায়, যা দেখে সম্পূর্ণ কার্টুন সিরিজ 'ফ্লিন্টস্টোনস'-এর শিল্পীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷ ফ্রেড ফ্লিন্টস্টোনকে নিয়ে এই অনবদ্য কার্টুন সিরিজটি তৈরি করেছিলেন উইলিয়াম হান্না এবং যোসেফ বারবেরা৷ ১৯৬০ থেকে প্রায় দীর্ঘ টানা ছ'বছর মার্কিন টেলিভিশনকে মাতিয়ে রেখেছিল এই সিরিজ৷
টিম ল্যামবার্ট জানিয়েছেন তুষার যুগ বা 'আইস এজ'-আদিম মানুষেরা শুধু যে গুহাবাসীই ছিলেন তা নয়, তারা গুহার বাইরে তাঁবুর মতো আস্তানাও নাকি বানিয়ে থাকতে অভ্যস্থ ছিলেন৷ সেই তাঁবু বানানো হতো বিশালাকায় প্রাণীর চামড়া শুকিয়ে, যেটা টাঙানো হতো সেই প্রাণীরই পায়ের হাড়কে খুঁটি বানিয়ে৷ এমনকী সেই প্রাণীর চামড়া দিয়ে পোশাক এবং পায়ের জুতা বানানোরও নাকি চল ছিল৷
তুষার যুগ শেষ হতে হতেই আমূল বদলে গেল মানবজাতির জীবন-যাপন৷ খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০ নাগাদ মধ্য-প্রাচ্যে মানুষ চাষ-আবাদ শুরু যে করল তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷ জেরিচো নামের জায়গায় যে মানুষের দল থাকতেন তারা মাটি রোদে শুকিয়ে নাকি ইট তৈরি করার পদ্ধতি জানতেন এবং তা দিয়ে দেয়াল গেঁথে ঘরও বানিয়ে ফেলতেন৷
বসত-বাড়ির ইতিহাসের এই পর্যন্ত তেমন কোনো চমক নেই৷ এরপর 'ক্যাটাল হুইউক' নামের একটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন তিনি, যেটা নাকি আজকের তুরস্ক৷ সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০৷ এখানেই গড়ে উঠেছিল মানব-সভ্যতার প্রথম নগর৷ সেই নগরের অধিবাসীর সংখ্যা আনুমানিক ছ’হাজার৷
ক্যাটাল হুইউকের বাড়ি তৈরি হতো কাদা-মাটির ইট দিয়ে৷ এবং একটা বাড়ির সঙ্গে পাশের অন্য বাড়ির মধ্যে কোনো ফাঁক থাকতো না, গায়ে-গা লাগিয়ে৷ একটা বাড়ি থেকে অন্য বাড়িকে আলাদা করা যেত না৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, কোনো বাড়িতেই দরজা ছিল না৷ নিরেট দেয়াল৷ তাহলে আবাসিকরা বাড়িতে ঢুকতেন কীভাবে? এই বাড়ির ছাদ ছিল শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি, সেই ছাদে ডালার মতো ব্যবস্থা থাকতো, যেটা তুলে বাড়ির ওপর থেকে প্রবেশ করতে হতো আবাসিকদের৷
দেয়ালের বদলে ছাদে কেন অমন দরজার ব্যবস্থা ছিল সে প্রসঙ্গে লেখক জানাচ্ছেন, নিরাপত্তার কারণে৷ দেয়ালের অনেক উঁচুর দিকে জানলার মতো গর্ত থাকতো কেবল, যা ঢাকা দেয়া থাকতো প্রয়োজনে পশুর-চামড়ার পরদা দিয়ে৷ ঘর থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য ছাদে থাকতো একটা নির্গমণ পথ, তাও ক্ষুদ্র৷ ঘরের মাটির দেয়ালে রঙ দিয়ে ছবি আঁকা৷
অধিকাংশই পশু-প্রাণীর৷ ক্যাটাল হুইউকের প্রতিটা বাড়িই যেহেতু গায়ে-গায়ে লাগানো, ফলে তাদের ছাদও ছিল একটার সঙ্গে অন্যটা লাগানো৷ ঐতিহাসিকেরা মনে করছেন, সেই নগরের বাসিন্দারা এই সম্মিলিত ছাদকে ব্যবহার করতেন রাস্তা হিসেবে৷ এই সম্মিলিত ছাদই ছিল বসত এলাকার থেকে বাইরে বেরনোর পথ৷
মাত্র দেড় হাজার বছরের এই শহরের মানব-জীবন শেষ হয়ে যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ সালে৷ সঠিক কারণ জানা যায় না, তবে অনেকেই মনে করেন হঠাত্ই আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তনের ফলেই শেষ হয়ে যায় এই নগর-জীবন৷ দীর্ঘ সাত হাজার বছর অজানাই ছিল আধুনিক মানুষের কাছে তাদের পূর্বপুরুষের এই অতীত জীবন৷
জেমস মেলাআর্ট নামের এক প্রত্নতাত্ত্বিক ১৯৫৮ সালে হঠাত্ই আবিষ্কার করেন এই প্রাচীন নগর এবং খননকার্য শুরু হয় ১৯৬১ সালে৷ উন্মোচিত হয় প্রাচীন বসত-বাড়ির আশ্চর্য এক ডিজাইন৷
আজ স্টিল-গ্লাস-কংক্রিটের আকাস-ছোঁয়া বাড়ির ডিজাইন দেখলে আমরা প্রতিনিয়ত চমকে যাই কিন্ত্ত এই বসতবাড়ির আদিজনক যে লুকিয়ে ছিলেন ক্যাটাল হুইউক নগরে, কে জানতো!
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে যত আবাসন তৈরি হচ্ছে, তার শতকরা চল্লিশভাগ নাকি অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে৷ যদিও এই রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন দেশের নানা প্রান্তের বিল্ডার-কন্ট্রাকটাররা কিন্ত্ত এই সমীক্ষা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তাও হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না৷
এ কারণেই যত দিন যাচ্ছে, ততই প্রতিটি আবাসনকে আকৃষ্ট করে তোলার জন্য আবাসিকদের নানা রকম চমকপ্রদ সুবিধা দেয়ার প্রতিজ্ঞা করছেন আবাসন নির্মাতারা৷ এর ফলেই প্রতিটি আবাসনই ক্রমশ হয়ে উঠছে 'এক্সক্লুসিভ' এবং 'ইউনিক'৷ এমনই দু'টি 'ইউনিক' বসতবাড়ির একটি জাপানে, অন্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷
আমেরিকা দিয়েই শুরু করি৷ ডিক ক্লার্কের নাম আমার-আপনার কাছে ততটা পরিচিত না হলেও মার্কিন নাগরিকদের কাছে তিনি প্রায় কালচারাল আইকনের মতো৷ একাধারে রেডিও এবং টেলিভিশন প্রেজেন্টার৷ টানা চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন টেলিভিশনে 'আমেরিকান ব্যান্ডস্ট্যান্ড' শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠান চালিয়ে গেছেন।
এমন কোনও মার্কিনি রক-পপ-ক্লাসিকাল শিল্পী নেই যিনি তার এ অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হননি৷ এতোই জনপ্রিয় তার এই অনুষ্ঠান যে তিনি একসময় 'অ্যামেরিকান ব্যান্ডস্ট্যান্ড' নাম দিয়ে চেন অফ রেস্ট্রূরেন্ট-এর ব্যবসা করে প্রায় ধনকুবেরে পর্যবসিত হয়ে ওঠেন৷
প্রতিটি ধনকুবেরেরই নানা রকম ফ্যাশন থাকে৷ ডিক ক্লার্কের ফ্যাশন ছিল 'ফ্লিন্টস্টোনস' পরিবারের প্রতি৷ সেই ফ্লিন্টস্টোন পরিবার যারা প্রস্তর যুগের মানুষ, কচি ডাইনোসর এবং অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর সঙ্গে যাদের ওঠা-বসা৷ এদের বাড়িটি ছিল পাথরের, ঘরের টেবিল-চেয়ার-বিছানা-ক্যাবিনেট সব পাথরের এবং আশ্চর্যভাবে আধুনিকযুগের সব টেকনোলজিই তারা পাথর দিয়ে বানিয়ে ফেলতেন৷
এদের নিয়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত টেলিভিশনে কার্টুন সিরিজ ছিল হিট৷ কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ডিক ক্লার্ক মনে-মনে বাসনা করে ফেলেছিলেন এমন একটি ফ্লিন্টস্টোন-মার্কা বাড়ির৷ প্রস্তাব দিলেন স্থপতি ফিলিপ জন ব্রাউনকে- ক্যালিফোর্নিয়ার মালিবু সমুদ্র-সৈকতে সান্টা মনিকা পান্থারের ঢালে ব্রাউন সাহেব পাথর দিয়ে বানিয়ে ফেললেন হুবহু তেমনই এক বাড়ি৷
বাড়ির ভেতরটায় কাঠ এবং স্টিল কংক্রিটের আড়ালে এমনভাবে ব্যবহার করলেন যেন মনে হয় সেটিও প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরযুগের৷ এমনকী আসবাব পর্যন্ত তৈরি হলো সেই কার্টুন সিরিজের মতো করে৷ বাড়িতে রয়েছে একটি বড়ো বেডরুম, দু'টি বাথরুম যার মোট আয়তন প্রায় ২৪০০ বর্গফুট৷
এটা যে নিজের থাকার জন্য বানালেন ডিক ক্লার্ক তা নয়৷ থেকেছেন বলে শোনাও যায়নি৷ ২০১২ সালে ৮২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে থেকেই বাড়িটি বিক্রির বিজ্ঞাপন বেরোতে শুরু করে যেখানে লেখা ছিল 'ফ্রেড ফ্লিন্টস্টোন'-এর বাড়ি কিন্ত্ত মিনি ডাইনোসর পাওয়া যাবে না৷' কোনও সন্দেহ নেই চমকপ্রদ আইডিয়া৷
কিন্ত্ত চমকপ্রদ হলেই যে বিক্রি হবে তার গ্যারান্টি এ-দেশে যেমন নেই, তেমন ও-দেশেও নেই৷ ডিক ক্লার্ক মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী জানালেন মাত্র ৩.২৫ মিলিয়ন ডলার কেউ দিলেই তিনি বাড়িটি বিক্রি করে দেবেন৷ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পরেও কেউ সাড়া দেয়নি৷ প্রায় দশ মাস বাদে মাত্র ১.৭৭ মিলিয়ন ডলারে এই আশ্চর্য বাড়িটি বিক্রি করে দেয়া গেল শেষ পর্যন্ত৷ তাও পানির দরে!
দ্বিতীয় বাড়িটি জাপানে৷ এটি অবশ্য প্রস্তর যুগের নয়, বরং বলা যেতে পারে 'আগামী কোনও এক যুগের'৷ টোকিও শহরে এই বাড়িটির নাম 'হাউস এনএ'৷ চারতলা বাড়ি৷ পুরো বাড়িটি কাচ দিয়ে তৈরি৷ ৯১৪ বর্গফুটের এই বাড়িটির স্থপতি সোউ ফুজিমোতো৷ এই বাড়িটিকে বলা হয় 'সি-থ্রু' হোম৷ যদিও কাচ ছাড়া বাড়িটিতেক কিছুই নেই কিন্ত্ত বাড়িটির ইউনিকনেস এখানে নয়৷
বাড়িটি তৈরি হয়েছে আমাদের আদি-পুরুষেরা যে ধরনের গাছ-বাড়িতে থাকতেন সেই ধারনার ওপর নির্ভর করে৷ যদিও সাদা স্টিলের ফ্রেম, যা গোটা বাড়ির কাচকে ধরে রেখেছে তার সঙ্গে গাছের চেহারার কোনও সাযুজ্য নেই, কিন্ত্ত এই বাড়িতে কয়েক ঘণ্টা কাটালে একটি মানুষের যে অভিজ্ঞতা হবে তার সঙ্গে সেই গাছ-বাড়িতে কাটানো মানুষের অভিজ্ঞতা হুবহু এক৷ অন্তত এমনটাই বলছেন সোউ ফুকিমোতো৷
যেমন, বাড়ির যেকোনও 'লেয়ার'-এ আপনি থাকুন কেন, আপনি তার ওপর বা নিচের স্তরের মানুষের কথা শুনতে পাবেন স্পষ্ট এবং ইচ্ছে করলে প্রায় গাছের ডাল ধরে ঝুলে অন্য ডালে চলে যাওয়ার ভঙ্গিতে এক লেয়ার থেকে অন্য লেয়ারে 'হপ' করে চলে যেতে পারবেন৷
বাড়িটির বিজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, আপনার যদি লুকোনোর কিছু না থাকে জীবনে, তাহলে কয়েকটা রাত কাটিয়ে এক অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুন এই গাছ-বাড়িতে এসে'৷ না, পাথরের বাড়ির মতো এই কাচের গাছ-বাড়িরও তেমন উত্সাহী গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না৷ অতএব, এটা কি শেখা গেল 'ইউনিকনেস' বা 'এক্সক্লুসিভ' ব্যাপার সব-সময় বিক্রি হয় না? অন্তত বসত-বাড়ির ক্ষেত্রে৷ সূত্র : এই সময়
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/