ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল : ১. রাজনের বিষয়ে কিছু একটা লেখার জন্য আমি হাতে একটা কলম এবং কিছু কাগজ নিয়ে গত কয়েক ঘণ্টা চুপচাপ বসে আছি, কিছু লিখতে পারছি না। কী লিখব? কীভাবে লিখব? আমি যেটাই লিখি সেটাই কী এখন পরিহাসের মতো শোনাবে না? রাজনকে সিলেটের কুমারগাঁওয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি কুমারগাঁওয়ে, সেই অর্থে আমিও কুমারগাঁওয়ের বাসিন্দা।
তাকে যেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেই জায়গাটি আমার বাসা থেকে কিলোমিটারখানেক দূরে হবে। সাত ভাইয়ের পরিবারের কয়েক ভাই মিলে রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আমার পরিচিতরা তাদের চিনে। সংবাদ মাধ্যম ছাড়াও স্থানীয় মানুষের কাছে আমার এই অবিশ্বাস্য রকমের নিষ্ঠুর ঘটনাটির কথা শুনতে হচ্ছে। আমি দুর্বল মনের মানুষ, এরকম ঘটনা শুনতে পারি না। কম্পিউটারের স্ক্রিনে তার হত্যাকাণ্ডের ভিডিও লিংক দেওয়া আছে। আমার পক্ষে সেটি দেখা সম্ভব নয়।
খবরটিও আমি দীর্ঘ সময় পড়ার সাহস পাইনি, আস্তে আস্তে পড়েছি। এই দেশে, এই সমাজে, এই এলাকায় এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে- আমি এই দেশে, এই সমাজ এবং এই এলাকার মানুষ, তীব্র একটা অপরাধবোধ আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি দেখিনি, শুনেছি সামাজিক নেটওয়ার্কে এই ঘটনার জন্য ভয়ঙ্কর একটি প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমি সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করছি, সারা দেশের মানুষের বিবেক এমনভাবে নাড়া দিয়ে উঠুক যেন ভবিষ্যতে এই দেশের মাটিতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে।
সামিউল ইসলাম রাজন ১৩ বছরের এক কিশোর। কিংবা কে জানে তাকে হয়তো কিশোর না বলে শিশু বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। আমি যে সামান্য লেখালেখি করি তা এই বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য তাদের চিন্তা-ভাবনার জগৎটি আমার পরিচিত। আমি অনুমান করতে পারি এই দেশের এই বয়সের সচ্ছল কিশোর-কিশোরীদের জীবন থেকে তার জীবনটা অনেক ভিন্ন। তাদের দরিদ্র সংসারে এই ১৩ বছরের কিশোরটি রিকশা-ভ্যানে সবজি বিক্রি করে সাহায্য করত। সে যদি সচ্ছল পরিবারের সন্তান হতো তাহলে তার বিরুদ্ধে রিকশা-ভ্যান চুরি করার মতো এতবড় একটা অপবাদ দিয়ে এরকম নৃশংসতা করা সম্ভব হতো না। সংবাদ মাধ্যমে এই নৃশংসতার আরও সম্ভাব্য কারণের কথা উঠে আসতে শুরু করেছে, আমি সেগুলো লিখা দূরে থাকুক মুখেও উচ্চারণ করতে পারব না।
তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার যে প্রক্রিয়াটি সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হয়েছে সেটি দীর্ঘ ২৮ মিনিটের। টানা ২৮ মিনিট একটা শিশুর ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা সম্ভব সেটি আমাদের বিশ্বাস করা কঠিন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি তামাশা করতে করতে এবং বিদ্রূপ করতে করতে যত্ন করে ভিডিও করার মানসিকতা কারও থাকতে পারে সেটি আমরা কল্পনাও করতে পারি না। নিজেরাই সেই ভিডিওটি ১০ জনকে দেখানোর জন্য সামাজিক নেটওয়ার্কে আপলোড করে দিতে পারে, সেটি নিজের চোখে দেখেও আমি বিশ্বাস করতে পারি না। এটি আপলোড করার পর সেখানে কতগুলো 'লাইক' পড়ে সেটি দেখাই কী তাদের মনের বাসনা ছিল? তাদের সেই মনের বাসনা কী পূরণ হয়েছে?
মানুষের ভিতরে আশ্চর্যরকম একটা জীবনীশক্তি থাকে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের শরীর বিস্ময়করভাবে চেষ্টা করে আমি সেটা জানি। ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী কিংবা পাকিস্তান মিলিটারির হাতে ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতিত হয়েছে- এরকম অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। (অনেকেই জানে না, আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টর্চার সেলে অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। ঠিক ছাড়া পাওয়ার পর পর সে আমাদের তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। এরপর সারা জীবন আর সেটি নিয়ে মুখ খুলেনি।
শারীরিক নির্যাতন করা মানুষের জন্য এত অবমাননাকর যে, যারা এর ভিতর দিয়ে গেছে তারা কখনো সেটি নিয়ে কথা বলতে চায় না। আমি মিলিটারির হাতে ধরা পড়া আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর কাছে শুনেছি টর্চার সেলে মার খেতে খেতে তারা যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যেত। আবার জ্ঞান ফিরে আসত- আবার অত্যাচারে জ্ঞান হারাত, তবুও বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাদের বাঁচিয়ে রাখত। স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনীর হাতে মার খাওয়া মানুষের কাছেও আমি একই গল্প শুনেছি। একবার আমন্ত্রিত হয়ে মুর্শিদাবাদে গিয়ে একসময়কার নকশাল আন্দোলনের কয়েকজন নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তারাও সেই একই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। প্রচণ্ড নির্যাতনে শরীরের প্রতিটি হাড় ভেঙে মৃত হিসেবে ফেলে রাখার পরও শুধু অদম্য জীবনীশক্তির জোরে তারা বেঁচে গিয়েছিলেন।
আমাদের ছোট্ট রাজনেরও নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার সেই অদম্য জীবনীশক্তি ছিল, বেঁচে থাকার জন্য তার আকুতিটুকু ২৮ মিনিটের পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ভিডিওটিতে রয়ে গেছে কিন্তু সে বাঁচতে পারেনি। তার ছোট্ট শরীরটাতেই ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন- ওই টুকুন শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন থাকার জায়গাটুকু কোথায়? চিহ্ন ছাড়া আঘাতের সংখ্যা কত? আমি সেটা কল্পনাও করতে চাই না।
দেশে আইনের বিচার নেই বলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে এক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা কী এই অমানুষিক নির্যাতনের পক্ষে একধরনের সাফাই নয়? যুক্তিটা অনেকটা এরকম- 'পুলিশের উচিত এই বয়সী শিশুকে এই ধরনের অপরাধের জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা। পুলিশ যেহেতু মারবে না, তাই আমরা পিটিয়ে মেরে ফেললাম।' কী ভয়ানক কথা! রাজনের ঘটনাটি আমাদের সামনে এসেছে বলে আমরা সবাই এত বিচলিত হয়েছি- কিন্তু আমরা কী আমাদের সারা জীবনের আমাদের চারপাশে এরকম অসংখ্য ঘটনা দেখিনি?
চোর ধরা পড়েছে শুনলে কী একেবারে নিপাট ভদ্রলোকেরাও চোরকে একদফা পিটিয়ে হাতের সুখ মিটিয়ে নেন না? আইন করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলা নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পরও কী শিক্ষকরা ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে যাচ্ছেন না? গৃহকর্ত্রীরা বাসার কাজের মেয়ে হিসেবে একেবারে অবোধ শিশুকে কী একেবারে রুটিনমাফিক গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেন না? আমাদের দেশের সব পত্র-পত্রিকা কী 'গণপিটুনি' কিংবা 'গণধোলাই' শব্দটি ব্যবহার করেনি- এই শব্দটি দিয়ে কী আমরা এই প্রক্রিয়াটির প্রতি প্রচ্ছন্ন এক ধরনের সমর্থন প্রকাশ করি না?
কাজেই সমস্যাটা অনেক গভীর। হয়তো এর সহজ ব্যাখ্যা নেই। হয়তো এর ব্যাখ্যা মানুষের জন্য গ্লানিময়, তাই হয়তো আমরা সত্যিকারের ব্যাখ্যাটি জেনেও না জানার ভান করি। কিন্তু এই কথাটি তো সত্যি রাজন যদি সমাজের উঁচুতলার একটি শিশু হতো তাহলে এত সহজে তাকে এভাবে নির্যাতন করার দুঃসাহস কেউ দেখাত না।
মানুষের মনের গ্লানিময় অন্ধকার জগৎ কিংবা রক্তের মাঝে মিশে থাকা নিষ্ঠুরতার বীজ হয়তো আমরা সরাতে পারব না কিন্তু মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে সম্মান দেখানোর খুব সহজ বিষয়টি তো আমরা চেষ্টা করলে আমাদের শিশুদের মনের মাঝে গেঁথে দিতে পারি। সবাই একটা দেশের বা সমাজের নেতৃত্ব দেয় না, যারা দেয় তাদের লক্ষ্য করে কেন সজ্ঞানে আমরা এই প্রক্রিয়াটুকু শুরু করি না? আমি চোখের সামনে দেখেছি বাংলাদেশ আর মুক্তিযোদ্ধাকে ভালোবেসে পুরো একটি প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। তাহলে মানুষকে ভালোবেসে কেন নতুন একটা প্রজন্ম গড়ে উঠতে পারে না?
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শিশু রাজনের মনের ভিতর ঠিক কী চিন্তা কাজ করেছিল আমরা কোনোদিন জানতে পারব না কিন্তু অনুমান করতে পারি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি এক গভীর অভিমান তার বুকের ভিতর হাহাকার করে গিয়েছিল। আমরা কী কখনো এই হাহাকার থেকে মুক্তি পাব?
২. ঈদের ঠিক আগে আগে এমন একটি মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখতে মনে চাইছিল না কিন্তু আমি জানি ১০ জনের সঙ্গে ভাগ করে নিলে মনের কষ্টটা কমে আসে। আমি তাই শুধু আমার মনের কষ্টটা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাইছি। ঠিক এই মুহূর্তে আমি মন ভালো করা একটি খবর পেয়েছি, ঈদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে সবার সঙ্গে এটাও ভাগাভাগি করে নিই?
আমরা সবাই জানি আমাদের ক্রিকেট টিম কী দাপটের সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশের মাঝে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। আমরা কী জানি ঠিক সেরকম আমাদের অলিম্পিয়াড টিমের কিশোর-তরুণরা একই ভাবে বাংলাদেশের পতাকা পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে শুরু করেছে? পদার্থবিজ্ঞানে একটা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে। গণিতে একটি রুপা এবং চারটি ব্রোঞ্জ! আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে এক লাফে ২০ ধাপ এগিয়ে আমরা এখন পৃথিবীর ৩৩তম দেশ! এটি কী কম কথা?
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/