এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে পৃথিবী, যার কারিগর মানুষই৷ যেন স্বখাতসলিল! নিছক 'ডুমস্ডে' বা 'আর্মাগেডন'-মার্কা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি নয়৷ মায়া-ইনকা সভ্যতার ক্যালেন্ডার মিলিয়ে 'মহাপ্রলয়' নিয়ে যারা দিনরাত আশঙ্কার জাল বোনেন ফেসবুক-টুইটারে, এই জিগির তাদেরও তোলা নয়৷ এই অশনি সংকেত একেবারেই বৈজ্ঞানিক৷ খবর ইন্ডিয়া টাইমস।
আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বাধীন একদল গবেষকের৷ তাদের আশঙ্কা, এত দ্রুত গতিতে বিভিন্ন প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যে, অচিরেই বিশ্বের উদ্ভিদ ও জীবজগতের শিয়রে সাক্ষাত্ শমনের মতো এসে দাঁড়াবে 'মাস এক্সটিংশন' বা মহাবিলুপ্তি৷ যা আগেও অন্তত পাঁচবার প্রায় প্রাণশূন্য করে ছেড়েছে পৃথিবীকে৷ শুধু তাই নয়, এ বারের মহাবিলুপ্তির অন্যতম প্রথম শিকার হতে চলেছে মানুষই৷ এবং বিভিন্ন প্রজাতির অবলুপ্তির এই যে বিপজ্জনক হার, তার নেপথ্যে রয়েছে খোদ মানুষেরই হাত৷ এই সাড়াজাগানো গবেষণাপত্র শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' নামে বিজ্ঞানপত্রিকায়৷
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির অধ্যাপক পল এহ্রলিখ বলছেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি মহাবিলুপ্তি বা 'মাস এক্সটিংশন'-এ অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ এর মধ্যে শেষটি ছিল ৬.৬ কোটি বছর আগে, যা ডেকে এনেছিল ডাইনোসরদের বিলুপ্তি (যার পিছনে এক উল্কাপাতের বিধ্বংসী অভিঘাত এবং আবহাওয়ার আরও নানা বৈশিষ্ট্যকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা)৷ তার পরে এই দীর্ঘ পরিসরের মধ্যে আর কোনও সময়ে এত দ্রুত হারে বিভিন্ন প্রজাতিকে অবলুপ্ত হতে দেখা যায়নি৷
সে জন্যই এহ্রলিখের কথায়, 'আমাদের গবেষণা সন্দেহাতীত ভাবে ইঙ্গিত করছে যে, আমরা ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির পর্যায়ে ঢুকে পড়েছি৷ এবং তার শিকার হতে চলেছে মানুষও৷' একই আশঙ্কার সুর গবেষণাপত্রের মূল লেখক, মেক্সিকোর অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরার্দো কেবালোসের গলায়৷ এখানে তাঁরা তুলে ধরেছেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার বা আইইউসিএন-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টও৷ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪১ শতাংশ উভচর এবং ২৬ শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রবল ভাবে বিপন্ন৷ এই প্রজাতিগুলিকে 'ওয়াকিং ডেড' বা 'হাঁটতে থাকা শব' হিসেবে বর্ণনা করে এহ্রলিখের আক্ষেপ, 'সারা বিশ্বে এমন অসংখ্য প্রজাতির দেখা মিলবে, যারা ইতিমধ্যেই বিলুপ্তির অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়েছে৷'
কীসের ভিত্তিতে এই আশঙ্কা গবেষকদের? সমীক্ষার জন্য প্রাগৈতিহাসিক যুগের তথ্য বিশ্লেষণ করে তত্কালীন স্বাভাবিক বিলুপ্তির হার খতিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা৷ সেখানেই ধরা পড়েছে ভয়াবহ ছবিটা৷ ওই হার অনুযায়ী, প্রতি ১০০ বছরে যদি ১০,০০০ মেরুদণ্ডী প্রজাতির মধ্যে মাত্র দু'টি বিলুপ্ত হয়ে যেত, তা হলে গত এক শতাব্দীতে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বিলুপ্তির হার তার তুলনায় ১১৪ শতাংশ বেশি! গবেষণাপত্রে স্পষ্টই বলা হয়েছে, এই বিশাল সংখ্যাটাই বুঝিয়ে দেয় যে, মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া ('উইদাউট হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি' অবলুপ্তির এই অস্বাভাবিক হার সম্ভব নয়৷ অর্থাত্, সর্বনাশের নেপথ্যে নিয়ামক সভ্যতার গর্ব করা মানবজাতিই!
অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রাণী-উদ্ভিদের সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়াও যে বিচিত্র নয়, সে কথাটাও শুনিয়ে রেখেছেন এই গবেষকদলের সদস্যরা৷ কেবালোসের কথায়, 'এ কথাটা বলে রাখা ভালো যে, আমাদের মূল্যায়ন সম্ভবত অবলুপ্তির সঙ্কটকে ঠিকঠাক ধরে উঠতে পারেনি৷ কারণ, বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের উপর মানুষের কু-প্রভাব কতটা, তা মাপার নির্দিষ্ট মানদণ্ড তো আমাদের হাতে নেই৷'
এই ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তি মানে কি পৃথিবীর শেষ দিন সমাসন্ন? বিজ্ঞানীরা কিন্ত্ত সমস্বরে বলছেন, না৷ তাদের গবেষণাপত্রকে মোটেই এত সরলীকরণ করা যাবে না, সেখান থেকে টানা যাবে না 'মহাপ্রলয়'-এর মতো সহজ লাইনও৷ এই দাবির পক্ষে তাঁদের বক্তব্য, আগের পাঁচটি মহাবিলুপ্তির পর অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ কখনও থেমে থাকেনি৷ যেমন, প্রায় ১৫ কোটি বছর ধরে দাপিয়ে বেড়ানো ডাইনোসরেরা ৬.৬ কোটি বছর আগে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে, পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল স্তন্যপায়ীদের দাপট৷ সুতরাং, প্রাণের উদ্ভব কোথায় কী ভাবে হবে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়৷
এর আরও একটা কারণ, পৃথিবীর বয়স যেহেতু ৪৫০ কোটি বছর, তাই তার কখন কোথায় কী অবস্থায় প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, তার অধিকাংশেরই নাগাল এখনও পায়নি বিজ্ঞান৷ তথ্যভাণ্ডারের এই ঘাটতি সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারি, পৃথিবী যদি সত্যিই ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির মুখে পড়ে, তা হলে সেই ধাক্কা সামলে উঠতে কয়েক কোটি বছর লেগে যেতে পারে৷ তার পর আবার কী ভাবে প্রাণের উদ্ভব ঘটবে, তা জানে একমাত্র প্রকৃতিই!
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে