এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: মাদকাসক্তির চিকিৎসা একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। কিন্তু চিকিৎসার সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলি বিষয় ও শর্তের উপর। গবেষণায় দেখা গেছে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হাপানির মত মাদকাসক্তির বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক চিকিৎসাও সমভাবে কার্যকর।
চিকিৎসার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আসক্ত ব্যক্তি বিষয়টি গোপন করে সহায়তা নেয়া থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে সে নিজে থেকে দেরিতে চিকিৎসা নিতে উৎসাহী হলেও ইতিমধ্যে চিকিৎসা জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
মাদকাসক্তির চিকিৎসার শুরুতে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস গ্রহণ, শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য মনোসমাজিক (অর্থনৈতিক অবস্থা, বাসস্থান, পড়াশুনা, চাকুরী) ও পারিবারিক অবস্থা নির্ণয় করা জরুরী। পারিবারিক সমর্থন ছাড়া মাসকাসক্তির চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব।
চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে মাদকাসক্তির কারণে সৃষ্ট বিষক্রিয়া মুক্তকরণ : আসক্তির তীব্রতা, ও মাদকের ধরণ ও মাদক ব্যবহারের উপর ডিটকিক্সফিকেশন এর পরিকল্পনা নির্ভর করে। তীব্র ধরনের শারীরিক আসক্তির যেমন হেরোইন, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের অপিয়েটস, বেনজোডায়াজেপিনস (ঘুমের ওষুধ), এলকোহল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ডিটকিক্সফিকেশন এর জন্য হাসপাতালে ভর্তি আবশ্যক। অনেকসময় মাদকাসক্ত ব্যক্তিগণ মাদকের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারেন কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যাহার জনিত বা ডরঃযফৎধধিষ বভভবপঃং (তীব্র ধরনের শারীরিক অসুবিধার কারণে কোন ব্যক্তির পক্ষে এটি সহ্য করা অসম্ভব) এর কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনা।
ডিটক্সিফিকেশন:
১। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে তার নিজের বা অভিভাবকের সম্মতিতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের (চংুপযরধঃৎরংঃ) তত্বাবধানে বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
২। ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে রোগীর অনিহা থাকলে চিকিৎসায় আশানুরুপ ফল পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে আসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা সেবায় আওতায় নিয়ে আসতে মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং (গড়ঃরাধঃরড়হধষ ঈড়ঁহংবষষরহম) বেশ কার্যকর পদ্ধতি।
পরবর্তীতে রোগীকে মাদকের ধরণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। অনেক সময় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা লাইসেন্স বিহীন ও ন্যুনতম চিকিৎসা সেবার সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এবং মানহীন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও রিহ্যাব সেন্টারের নামে যে চিকিৎসা দেওয়া হয় তা অপচিকিৎসা। মাদকাসক্তির চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবসময় বিজ্ঞানভিত্তিক (ঊারফবহপব নধংবফ) চিকিৎসার মানদন্ড অনুসরণ করতে হবে।
অনেকে মনে করেন ডিটক্সিফিকেশনের পর মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি মিলবে। আসলে এটি চিকিৎসার শুরু। এমন দেখা যায় যে, রিহ্যাব সেন্টার থেকে বের হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে মাদক নিচ্ছে। আসক্ত ব্যক্তির অভিভাবকগণ অনেকসময় জানতে চান এমন কোন ওষুধ আছে কিনা যা খেলে আর মাদক নিবেনা। এক কথায় এর উত্তর এ রকম কোন ওষুধ পৃথিবীতে এখনো আবিস্কৃত হয়নি। তাহলে সংক্রামক ব্যাধির মতো (টাইফয়েড জ্বর) এর চিকিৎসা সহজ হতো। মাদক থেকে মুক্ত থাকতে কিংবা পুনরাসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে কিছু বাস্তব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
প্রায় সকল মাদকাসক্ত ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সমস্যা থাকে। সমস্যাগুলি এতটাই প্রকট যে, এতে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়।
মাদকাসক্তির কারণে সৃষ্ট মানসিক রোগসমূহ:
১। বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা
২। ম্যানিয়া
৩। উদ্বেগজনিত সমস্যা
৪। ঘুমের সমস্যা
৫। সাইকোটিক ডিসঅর্ডার (অহেতুক সন্দেহ, অস্বাভাবিক চিস্তা, অসংলগ্ন কথাবার্তা ও আচরণ, ভাংচুর ও সহিংস আচরণ, হ্যালুসিনেশন ইত্যাদি)
৬। যৌন সমস্যা অন্যতম।
মাদকাসক্তির কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা:
১। শারীরিক সমস্যার মধ্যে খাবারে অরুচি, পুষ্টিহীনতা, শরীরের বিভিন্নস্থানে সংক্রমণ (ইনজেকশন ব্যবহারকারীদেব ভেতর বেশী), বিভিন্ন অঙ্গের রোগ যেমন, যকৃত, অন্ত্র, কিডনিসহ বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকর রোগ ও ইনজুরি ও এক্সিডেন্ট এবং হেপাটাইটিস ও এইডস এর প্রভাবে মৃত্যু পর্যস্ত হতে পারে।
২। অনেকসময় একসঙ্গে অতিরিক্তি মাত্রায় মাদক গ্রহণে মাদকের বিষক্রিয়ায় (ওহঃড়ীরপধঃরড়হ) অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা ও খিচুনী সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা যায় যা জীবনহানির কারণ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাদকাসক্তির কারণে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যার চিকিৎসা:
সামাজিক সমস্যার মধ্যে চুরি, ছিনতাই, সামাজিক সহিংসতা, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি অন্যতম। এসব সমস্যার সমাধানে সমস্যা অনুযায়ী মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে ওষুধ ও মনোসামাজিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
ঐধৎস জবফঁপঃরড়হ কৌশল:
Harm Reduction কৌশল: প্রাথমিক পর্যায়ে মাদক সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে সমর্থ না হলে তখন চিকিৎসা অন্যতম উদ্দেশ্য মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো যা ঐধৎস জবফঁপঃরড়হ কৌশল নামে পরিচিত। বিশেষত ইনজেকশন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সিরিন্জ শেয়ার করার কারণে হেপাটাইটিস ও এইডস সংক্রমণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। এ জন্য এসব মাদকসেবীদের মধ্যে সচেতনতামূলক স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম ও ঝুকিপূর্ণ আচরন ও মাদকদের ব্যবহার কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়।
Demand Reduction কৌশল ও মাদকাসিক্ত প্রতিরোধ:
সমাজে মাদকের প্রাপ্যতা নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। এজন্য সমাজে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মাদকের চাহিদা ও ব্যবহার কমিয়ে আনা জরুরী যা উবসধহফ জবফঁপঃরড়হ কৌশল হিসেবে পরিচিত। বেকারত্ব, কর্মসংস্থান ও সুস্থ বিনোদনের অভাব মাদক ব্যবহারের ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। এজন্য তরুণদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, সুস্থ বিনোদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে আইন শৃংখলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। মাদকের চিকিৎসা দীর্ঘময়োদী ও ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রতিরোধই উৎকৃষ্ট পন্থা। এজন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সচেতনতা এবং সমম্মিলিত প্রয়াস।
ডা. জিল্লুর রহমান রতন
সহকারী অধ্যাপক,
শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি