এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : তিনটি কঙ্কাল, একটি দগ্ধ দেহ৷ ঘর থেকে ভেসে আসে ভৌতিক আওয়াজ৷ পাগলের মতো এ ঘর থেকে ও ঘরে হাঁটছেন একটি লোক৷ হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে পুলিশের৷ বুধবারের নিশুত রাত৷ বৃদ্ধের দগ্ধ দেহ ছিল বন্ধ বাথরুমে৷
পাশের ঘরে উন্মাদের মতো আচরণ ওই বৃদ্ধেরই বছর পঁয়তাল্লিশের ছেলের৷ পুলিশের মনে হলো, বৃদ্ধ আত্মঘাতী হয়েছেন৷ তার শোকেই ভেঙে পড়েছেন ছেলে৷ কিন্তু ওই ঘরেই যে দু'টি কুকুর আর একটি মানুষের কঙ্কাল আছে তা কে জানতো! পুলিশের দুশ্চিন্তা, বাবার শোকে ছেলে চরম পথ নিতে পারে৷ তার ওপর নজর রাখতে সারারাত জেগে দুই পুলিশ কনস্টেবল৷ কিন্তু রবিনসন স্ট্রিটের ওই বাড়িতে আরো গভীর রহস্য লুকিয়ে ছিল৷
ঘরের মধ্যে কঙ্কাল
বৃহস্পতিবার সকাল৷ পুলিশ-পড়শি সবার চোখমুখে ঘোর বিস্ময়৷ সারারাত দু'চোখের পাতা এক করেননি পার্থবাবু৷ সকালে শেক্সপিয়র সরণি থানার ওসিসহ অভিজ্ঞ পুলিশ আধিকারিকরা চলে যান ঘটনাস্থলে৷ তখনও চেয়ারে ঠায় বসে পার্থবাবু৷ তার কথাবার্তা তখনো বেশ অসংলগ্ন৷
প্রথমে তাকে পাশেই কাকার বাড়িতে রাখতে চেয়েছিল পুলিশ৷ কিন্তু রাজি ছিলেন না পার্থ৷ এমনকি কোনো হোমেও নয়৷ সকালে পার্ক স্ট্রিটের একটি মিশনারি হোমে পার্থবাবুকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পুলিশ৷ কিন্তু ওই হোমে সিট না থাকায় পার্থবাবুকে শেক্সপিয়র সরণি থানায় নিয়ে আসে পুলিশ৷ থানায় চলে আসেন ডিসি (সাউথ) মুরলিধর শর্মাও৷
সামনে এতজন পুলিশ অফিসারের সামনে প্রথমে খানিকটা চুপচাপ বসেছিলেন পার্থবাবু৷ হঠাৎ নিজের থেকেই বলে উঠলেন, আই হ্যাভ ডান সামথিং, দ্যাট ইজ ক্রাইম ইন দ্য আইজ অব ল৷ বাট হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড মাই সেন্টিমেন্টস৷ পুলিশ অফিসাররা তখন চুপ৷
পার্থ বলে চলেন, আমার দিদি ছ’মাস আগে মারা গেছে। ওর কঙ্কাল এখনো আমার ঘরেই রয়েছে৷ শুধু পুলিশ কেন, পাশের বাড়িতে ওই বৃদ্ধের ভাইয়ের পরিবার বা বাড়ির গেটে ২৪ ঘণ্টা মোতায়েন নিরাপত্তারক্ষীরাও টের পাননি। বাড়ির তিনতলার বাসিন্দা অরবিন্দ দে (৭৭) ও তার ছেলে পার্থ দে ঘরের মধ্যেই তিনটি কঙ্কাল নিয়ে ছ’মাস ধরে রয়েছেন৷ ওই পরিবারের দু'টি পোষা ল্যাব্রাডর বা অরবিন্দবাবুর মেয়ে দেবযানীর (৪৭) দেখা নেই মাস ছয়েক৷ সেটা জানতেন সকলে৷ কিন্তু মাথা ঘামাননি কেউ৷
বন্ধ ঘরে ভৌতিক আওয়াজ
পার্থর কথা তখনও বিশ্বাস হয়নি পুলিশের৷ সত্যিই কি ছ’মাস একই ঘরে বোনের মৃতদেহ নিয়ে থাকা সম্ভব? আশপাশের কেউ টেরই বা পেলেন না কেন? অজস্র প্রশ্ন৷ উত্তর নেই৷ পার্থবাবুকে থানায় বসিয়ে রেখে ঘটনাস্থলে যান ডিসি, ওসিরা৷ তিনতলার ফ্ল্যাটের তালা খুলতেই খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন অফিসাররাও৷ ঘরে যেন কার স্বর ভেসে আসছে! তা হলে কি ঘরে আরো কেউ?
ড্রইং রুম পেরিয়ে বৃদ্ধের ঘরে যেতেও সেই একই স্বর৷ রান্নাঘর, বাড়ির ব্যালকনিতেও একই আওয়াজ৷ ভৌতিক সুর৷ ভাসছে৷ ভেসেই যাচ্ছে৷ খোঁজ করতে গিয়ে পুলিশ দেখে, ঘরের বিভিন্ন কোণে বসানো মিউজিক সিস্টেম৷ তাতে গোঁজা পেন ড্রাইভ৷ ভৌতিক স্বর ভেসে আসছে ওই মিউজিক সিস্টেম থেকেই৷
ঘরের মাঝখানে প্যাসেজ দিয়ে যাতায়াতের সময় সামান্য দুর্গন্ধও পাননি পুলিশকর্মীরা৷ কিন্তু ড্রয়িংরুম থেকে পাশের বেডরুমে ঢুকতেই নাকে কাপড় চাপা দিল পুলিশ৷ ঘরের মধ্যে একটি খাট৷ তার পাশে মেঝেতে একটি সাজানো বিছানা৷ তাতে কম্বলে ঢাকা একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের কঙ্কাল৷ পাশে প্লেটে সাজানো কেক, পেস্ট্রি, পানীয়ের বোতল৷ কঙ্কালটির মাথার কাছে পড়ে বিভিন্ন সাইজের কয়েকটি টেডি বিয়ার৷ ঠিক যেন কোনো প্রিয়জনের জন্মদিনের আয়োজন৷ বিছানার আর এক পাশে পড়ে আরো বেশকিছু হাড়গোড়৷ মানুষের নয় কুকুরের৷
দিদিই আমার সবকিছু
ঘটনাস্থল থেকে থানায় গিয়ে ফের পার্থবাবুকে একপ্রস্থ জেরা৷ পার্থ বলেন, আমার দিদিই আমার সবকিছু ছিল৷ গত বছর ডিসেম্বরে ও অসুস্থ হয়ে মারা যায়৷ ওকে আমি এত ভালোবাসতাম৷ তাই কীভাবে ওর দেহ সত্কার করব? পার্থবাবুর সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, পার্থ ও দেবযানী দু'জনই বি টেক পাস৷ পরে চাকরি সূত্রে বিদেশে চলে যান পার্থ৷
বছর দশেক আগে পর্যন্ত ক্যালকাটা গার্লস স্কুলসহ দু'টি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়াদের গান শেখাতেন দেবযানী৷ সেখানে কেউ কখনও তার আচরণে কোনো অস্বাভাবিকত্ব লক্ষ করেনি৷ ২০০৭-এ তাঁদের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই বদলে যায় তাদের জীবনযাত্রা৷ বিদেশের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফেরেন পার্থ৷
দেবযানীও স্কুলে গান শেখানোর কাজ ছেড়ে দেন৷ দু'জনই একটি ধর্মীয় সংস্থায় দীক্ষা নেন৷ সারাদিনের সঙ্গী ছিল দু'টি পোষা ল্যাব্রাডর৷ কাকা অরুণ দের পরিবারের সঙ্গেও অরবিন্দবাবুদের তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না৷ মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হলেও দু'বাড়ির লোকজনের যাতায়াতও বড় একটা ছিল না৷
পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর অগস্ট মাস নাগাদ একটি কুকুর মারা যায়৷ তার ক'মাস বাদে মারা যায় অন্য কুকুরটিও৷ কিন্তু ভাই-বোন দু'জনেই চাননি পোষা কুকুরগুলোকে কাছছাড়া করতে৷ তাই দু'টি কুকুরের দেহও রাখা ছিল পার্থ-দেবযানীর শোওয়ার ঘরেই৷ পার্থ পুলিশকে জানিয়েছেন, দেবযানীদেবীর মৃত্যু হয়েছে গত বছর ডিসেম্বর নাগাদ৷
তার দাবি, অসুস্থ হয়েই মৃত্যু হয় দিদির৷ প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, ধর্মীয় সংস্থায় দীক্ষা নেয়ার পর দেবযানীদেবী খাওয়াদাওয়া একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ ফলে এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন৷ একই ঘরে কুকুরের মৃতদেহ থেকে কোনো সংক্রমণও হয়ে থাকতে পারে তার৷
বাবা প্রথমে মানতে চাননি
পুলিশকে যেটা ভাবাচ্ছে তা হলো পার্থবাবু তার দিদির দেহ নিয়ে একই ফ্ল্যাটে থাকতে চাইলেও অরবিন্দবাবু তাতে রাজি ছিলেন কি না৷ পুলিশকে পার্থবাবু জানিয়েছেন, তার বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না৷ মেয়ের মৃতদেহ ঘরেই থাকবে, মানতে চাননি অরবিন্দবাবু৷
ছেলের জেদের কাছে সম্ভবত হার মানতে হয় তাকে, অনুমান পুলিশের৷ শুধু তাই নয়, দেবযানীর মৃত্যুর বিষয়টি অরুণবাবু বা নিরাপত্তারক্ষীদেরও ঘুণাক্ষরে টের পেতে দেননি৷ নিজের বেডরুমে মেঝেতে আলাদা বিছানা করে দেবযানীর দেহ শুইয়ে রাখেন পার্থ৷ সম্ভবত প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মাকে নামানোর 'কৌশল 'ও রপ্ত করছিলেন তিনি৷ প্রতিদিন রাতে দেবযানীর আত্মার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন পার্থ৷
অরবিন্দবাবু আত্মঘাতী কেন?
বৃদ্ধ অরবিন্দবাবু কেন আত্মঘাতী হলেন তা স্পষ্ট নয়৷ তার ঘর থেকে পাওয়া সুইসাইড নোটেও নিজের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেননি অরবিন্দবাবু৷ আর্জি রেখেছেন, ঈশ্বর যাতে তার ছেলেকে দেখেন৷ পুলিশের অনুমান, মেয়ের মৃত্যু ও ছেলের অবসাদে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধও৷ সম্ভবত সেই কারণেই বুধবার আত্মঘাতী হন তিনি৷ পার্থবাবু তখন ছিলেন নিজের ঘরে৷ ঘরের ভিতর ধোঁয়া দেখেও উত্স প্রথমে বুঝতে পারেননি৷
তিনতলার বাথরুম থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে আতঙ্কে চিত্কার করতে শুরু করেন নিরাপত্তারক্ষীরাও৷ তারাই দমকল ও পুলিশে খবর দেন৷ ফ্ল্যাট থেকে ছ'টি ল্যাপটপ, দু'টি ডেস্কটপ, বেশ কয়েকটি পেনড্রাইভ, মিউজিক সিস্টেম মিলেছে৷ সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ আদালতের নির্দেশে পার্থবাবুকে গোবরা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে৷ সূত্র : এই সময়