রাজশাহী প্রতিনিধি : রাজশাহীর বাঘায় সেই বই পড়া আন্দোলন ‘আলোর মিছিল’এর প্রতিষ্ঠা যুবক জুবায়ের আল মাহমুদ রাসেল জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্ব শান্তির মডেল উপস্থাপন করলেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বাঘায় সুধীজনদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি এই মডেল উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাঘা সহকারী ভূমি কমিশনার ও নির্বাহী মেজিস্ট্রেট শিমুল আখতার, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাঘা উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান শফিউর রহমান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, বাঘা কাজী আব্দুল মোকিম, উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম, আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ (কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক)। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ প্রামানিক ও সঞ্চালনা: মো. হামিদুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জুবায়ের আল মাহমুদ রাসেল উপস্থপিত জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটাই হতে পারে ‘বিশ্ব শান্তি’র শ্রেষ্ঠ মডেল।তাই বিষয়টি সরকারকে আমলে নিয়ে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।
সেই সাথে যুবক জুবায়ের আল মাহমুদ রাসেল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে তার উদ্ভাবীত ‘বিশ্ব শান্তি’র মডেল উপস্থাপন ও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতির আবেদন জানিয়েছেন। মডেলটি উপস্থাপনের পর এ প্রসঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন।
খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি একজন বাংলাদেশের নাগরিক। আমার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামে। আমি ২০১১ সাল থেকে সৃজনশীল মানুষ তৈরির জন্য বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লাইব্রেরী গঠন করে বইপড়ার আন্দোলন করে আসছি। পাশাপাশি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে আমার বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য প্রতিবছর পাঠক তথা স্ব স্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সৃজনশীল অভিযান পরিচালনা করে থাকি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি নিশ্চয় জানেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যে কোন দেশের মোট সমভূমির ২৫% বন থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই তা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বিশ্বাস করুন আমি এমন একটি মডেল দাঁড় করিয়েছি যে মডেলটি বাস্তবায়ন করলে শুধু আমাদের দেশ নয়, বরং পৃথিবীর সব দেশ নিজেদের মোট সমভূমির ২৫% বনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
আমার উদ্ভাবিত এই ‘বিশ্ব শান্তি’র মডেল শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করবে না বরং তা বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জটিও মোকাবেলা করবে। আমার উদ্ভাবিত এই মডেটি পত্রের সঙ্গে সংযোজন করলাম। ‘বিশ্ব শান্তি’র এই মডেলটি সম্পর্কে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে আপনাকে বিস্তারীত বুঝিয়ে বলতে চাই।
অতএব, বিনীত প্রার্থনা যেহেতু উক্ত মডেলটি শুধু আমার দেশ নয়, বরং পুরো বিশ্ববাসীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন।’
জুবায়ের আল মাহমুদের উত্থাপিত মডেল :
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটাই হতে পারে ‘বিশ্ব শান্তি’র শ্রেষ্ঠ মডেল
মো. জুবায়ের আল মাহমুদ: পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল এক সময় বন-বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু মানুষ বন জঙ্গল উজার করে সেই সব জায়গায় গড়ে তুলছে শিল্প কলকারখানা, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা। ফলে শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া ও গাছপালা হ্রাসের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি আশঙ্কাজনকহারে হারে বাড়ছে ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এর ফলে ওজন স্তরে দেখা দিয়েছে ফাটল। এ কারণে পৃথিবীতে বাড়তে থাকায় গলতে শুরু করেছে এন্টার্কটিকা ও হিমালয় পর্বতের বরফ। এভাবে আশঙ্কাজনকহারে বরফ গলার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এমন নানা কারণে দেশে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, সিডর কিংবা আইলার মতো মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
ইন্ডিয়ান ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজি সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক সায়েন্স বিভাগ বলছে, ভারতীয় উপমহাদেশে আশঙ্কাজনকহারে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে। পাশাপাশি শুকনো মৌসুমে নদ-নদীতে পানি না থাকায় সমুদ্র পৃষ্ঠের লোনা পানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসছে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় অনাবাদি হয়ে পড়ছে ফসলি জমি। যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আবার অতিরিক্ত খরায় ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চল মুরুভূমিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কায়।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্যমতে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে।
এছাড়া দ্যা সায়ন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ (এসসিএআইআর) জানিয়েছে, যে হারে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে তাতে আগামী ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।
মানুষ বসবাসের জন্য বাংলাদেশ তথা সমস্ত পৃথিবীই যে হুমকির মধ্যে রয়েছে তা উপরের তথ্যমতে স্পষ্ট। পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট যে, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব? চিন্তার কিছু নেই, আমি বলছি সম্ভব। কিভাবে এই বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে মূলত সেই বিষয়টি পরিষ্কার করতেই আমার এই লেখা।
গাছপালা বাতাসে নির্গত এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীতে ক্ষতিকর এই গ্যাসকে বৃদ্ধি পেতে বাধা প্রদান করে। ফলে ওজন স্তরের ফাটল রোধের পাশাপাশি গাছপালা আমাদের দিচ্ছে নির্মল অক্সিজেন।
তাহলে বলা যায়, গাছ রোপণই পারে ওই ক্ষতিকর গ্যাস থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোন দেশের মোট সমভূমির ২৫ শতাংশ যদি গাছপালা বা বন থাকে, তাহলে সেই দেশ যে কোন প্রাকৃতিক দূযোর্গ সহজেই মোকাবেলা করতে পারবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন আপনার মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জেগেছে যে, ২৫ শতাংশ বনায়ন করা আসলেই কি সম্ভব?
ভাববেন না, আমি বলছি সম্ভব। কিভাবে সম্ভব তা আমি নিচে তুলে ধরলাম।
২৫ শতাংশ বনায়ন করার উপায়:
আমার মতে, ২৫ শতাংশ বনায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কঠিন কোন পদক্ষেপ নয় বরং তা খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এখন নিশ্চয় বলবেন কিভাবে?
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়ার আগে আপনার অবগতির জন্য একটু বলে নিই, আসলে সৃজনশীল মানুষ তৈরির লক্ষ্যে আমি রাজশাহী-নাটোরের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লাইব্রেরী গড়ার মাধ্যমে বইপড়ার আন্দোলন করি। পাশাপাশি আমার দেশের মোট সমভূমির ২৫ শতাংশ বন তৈরির লক্ষ্যে ওই সকল বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ করি।
বৃক্ষরোপণের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বছরে মাত্র একদিন বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করলে শুধু আমাদের দেশ নয়, বরং পৃথিবীর সব দেশ নিজেদের মোট সমভূমির ২৫ শতাংশ বনায়নের লক্ষ্যমাত্র পূরণ করতে পারবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃক্ষরোপণের মতো সৃজনশীল কাজ করলে তাদের ছোট্ট মনে ছোটবেলাতেই জন্মনেবে দেশপ্রেম।
এবার একটু অংক করে দেখা যাক। আমাদের দেশে সব মিলিয়ে অন্তত দেড়-লক্ষাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে পড়াশোনা করছে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি প্রতি বছর মাত্র একটি করে গাছ নিজেদের পতিত জমিতে রোপণ করে, তাহলে বছরে ৫ কোটি গাছ রোপণ হবে। গাছগুলো শিক্ষার্থীরা নিজেদের জমিতে রোপণ করবে বিধায় পরিচর্যার কোন ঘাটতি হবে না।
অন্যদিকে, আমাদের দেশের গ্রামগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, গ্রামে একটি বসতবাড়ি নির্মানের জন্য প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে প্রায় ৮-১৩ শতাংশ জমি এবং ব্যয় করছে অন্তত ৭-৯ লক্ষ টাকা। কিন্তু নির্মিত সেই বাড়িতে বসবাস করছে মাত্র একটি পরিবার। বসতবাড়ি নির্মানের এই প্রাচীন পদ্ধতির ফলে একদিকে উজার হচ্ছে গাছপালা অন্যদিকে কমে যাচ্ছে ফসলি জমি। ফলে আগামীতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
তাই বাড়ি নির্মানের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। সেটা হলো ‘গ্রামীণ নগরায়ণ’। অর্থ্যাৎ সরকার যদি কোন গ্রামে পরিবার প্রতি ৭-৯ লক্ষ টাকা (কিস্তিতে) নিয়ে এবং কিছুটা ভূর্তুকি দিয়ে ওই ৮-১৩ শতাংশ জমিতে ৫০ তলা বিশিষ্ট ১টি বিল্ডিং নির্মান করে, তাহলে সেখানে প্রায় ২ শতাধিক পরিবার বসবাস করতে পারবে। তার মানে হলো- কোন গ্রাম যদি ২শ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই গ্রামে এরূপ ৪-৬টি বিল্ডিং নির্মান করলে মাত্র ৮-১০ বিঘা জমিতেই পুরো গ্রামের মানুষ বসবাস করতে পারবে। এর ফলে আমাদের দেশের আবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে যাবে বহুগুণ।
এবার হিসাবটি বড় করে দেখা যাক- বাংলাদেশে তো মাত্র দেড় লাখ (প্রায়) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু জাতিসংঘের আওতাধীন ১৯৫টি দেশে রয়েছে কোটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে পড়াশোনা করছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী।
জাতিসংঘ যদি এই সব কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করে, তাহলে প্রতিবছর কোটি কোটি গাছ রোপণ সম্ভব হবে। পাশাপাশি ফসলি জমি বৃদ্ধির জন্য ‘গ্রামীণ নগরায়ণ’ রূপকল্পটি যদি বাস্তবায়ন করে। তাহলে আমরা একদিকে যেমন পৃথিবীতে অক্সিজেনে ভরিয়ে দিতে পারবো, সেই সঙ্গে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও খুব সহজেই মোকাবেলা করতে পারবো।
বৃক্ষরোপণ ও গ্রামীণ নগরায়ণের এই ধারণাটিকেই মূলত আমি ‘বিশ্ব শান্তি’র মডেল বলছি।
উপরে উল্লেখিত মডেল যদি আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দেশটি সবুজ অরণ্যে পরিণত হবে। অপরদিকে, মডেলটি বাস্তবায়নে জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে পুরো পৃথিবীটাই বিশাল অরণ্যে পরিণত হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, দয়াকরে ‘বিশ্ব শান্তি’র এই মডেলটি আপনি আমাদের দেশে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিন। সেই সঙ্গে আগামী বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ‘বিশ্ব শান্তি’র এই মডেলটি উপস্থাপন করে বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীকে আগামী দিনে নতুন করে বেঁচে থাকার একটু স্বপ্ন দেখান।
উল্লেখ্য, মো. জুবায়ের আল মাহমুদ রাজশাহীর বাঘায় সেই ‘আলোর মিছিল’নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন ধরে বই পড়া আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। তিনি বাঘা উপজেলার প্রায় ৪১টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে নিয়মিত বই বিতরণ এবং সেখানে পৃথকভাবে পাঠাগার গড়ে তোলেছেন। তিনি বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউট পিজিডিজি কোর্সে অধ্যয়নরত।
২৮ জানুয়ারি ২০১৬ এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ