মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:০০:০৬

২৫ বছরে মহাজাগতিক চোখ

২৫ বছরে মহাজাগতিক চোখ

বিপাশা চক্রবর্তী: নাসার প্রশাসক চার্লি বোল্ডেন বলেছেন, 'বিশ্ব সম্পর্কে এবং বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের যে ধ্যান-ধারণা, ২৫ বছরে হাবল আমাদের সেই ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছে।' মহাকাশের এই পর্যবেক্ষক আরও পাঁচ বছর অন্তত সক্রিয় থেকে দূরাকাশের রোমাঞ্চকর খোঁজখবর উপহার দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।

২৫ বছরে মহাজাগতিক জানালা_ টেলিস্কোপ হাবল

২৪ এপ্রিল ১৯৯০, ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে রওনা হয় স্পেস শাটল 'ডিসকভারি'। সেটির সঙ্গে বহন করা হয়েছিল অতি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ১১,১১০ কেজির একটি কার্গো, যাতে ছিল অতি উন্নত প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও এন্টেনা। আর এটিকে স্থাপন করা হয় পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৫৯৬ কিলোমিটার উঁচুতে। আর এভাবেই সক্রিয় হয় টেলিস্কোপ হাবল। যা পৃথিবীবাসীর কাছে এক মহাজাগতিক 'জানালা বা চোখ' হিসেবে পরিচিতি পায়। আমাদের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত করে এক অপার মহাজাগতিক সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার দ্বার। আর এটিই আমাদের এই মহাবিশ্বকে বুঝতে, জানতে ও পর্যবেক্ষণ করতে সর্বোপরি, মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য আবিষ্কার করতে এক অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছে_ সাহায্য করে আসছে ২৫ বছর ধরে।
এখন পর্যন্ত পাঁচটি সার্ভিসিং মিশনের মাধ্যমে এতে যুক্ত করা হয়েছে সর্বশেষ আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি, বাড়ানো হয়েছে এর দক্ষতা ও সক্ষমতা। বর্তমানে আরও নতুন ও উন্নত যে সব টেলিস্কোপ নির্মিত হচ্ছে তা হাবল টেলিস্কোপের অভিজ্ঞতা থেকেই। এটির নামকরণ করা হয়েছিল বিজ্ঞানী অ্যাডউইন পি. হাবলের (১৮৮৯-১৯৫৩) নামানুসারে। যিনি সর্বপ্রথম মহাজাগতিক বস্তুগুলোর বস্তু শিফট এবং রেড শিফট দেখিয়ে প্রমাণ করেন এ মহাজগৎ সম্প্রসারণশীল। যেখানে প্রতিটি বস্তুই আরেকটি বস্তু থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। আর এটির ওপর ভিত্তি করেই পরে মহাবিস্টেম্ফারণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে এই মহান বিজ্ঞানীকে সম্মান জানিয়ে টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয় 'হাবল টেলিস্কোপ'।

টেলিস্কোপটি নিয়ন্ত্রিত হয় পৃথিবী থেকে। এটি মূলত একটি ক্যাসেগ্রেইন রিফ্লেক্টর ঘরানার টেলিস্কোপ। সহজ করে বললে প্রতিফলন টেলিস্কোপ। যা আয়নার প্রতিফলনে দূরতম বস্তুর তথ্য ধারণ করে। ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে এতে জুড়ে দেওয়া হয় চন্দ্র এক্সরে টেলিস্কোপ। এর ক্ষমতা এতটাই যে, দেড় মাইল দূর থেকে দেড় ইঞ্চির কোনো লেখা অনায়াসে পড়া সম্ভব। ঘণ্টায় ২৮,২০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসে হাবল টেলিস্কোপ। আর যাবতীয় শক্তির প্রয়োজন সে পূরণ করে সূর্যের আলো থেকে। এর জন্য রয়েছে ২৫ ফুট লম্বা দুটি সৌর প্যানেল। আর শক্তি সঞ্চয় করে রাখার জন্য রয়েছে ৬টি নিকেল হাইড্রোজেন ব্যাটারি। যেগুলো একত্রে বিশটি গাড়ির বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে সক্ষম। টেলিস্কোপটি অতি বেগুনি থেকে অবলোহিত (যা খালি চোখে দেখা যায় না) অর্থাৎ, ১১৫-২৫০০ ন্যানোমিটারে আলোর সব তরঙ্গ দৈর্ঘ দেখতে সক্ষম। এই আশ্চর্যরকম ক্ষমতা নিয়ে হাবল যা পর্যবেক্ষণ করে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি সপ্তাহে ১২০ গিগাবাইট তথ্য পাঠায়। তাতে অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণে তাই ব্যবহার করা হয় ম্যাগনেটো অপটিক্যাল ডিস্ক।

পৃথিবীতে ১৯৯০ সালের ২০ মে হাবল তার প্রথম ছবি পাঠায়। সেই থেকে লক্ষাধিক ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। আর সেসব ছবি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে মহাবিশ্বের বয়স। জানা গেছে, ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণ শক্তি সম্পর্কে। পৃথিবীর এই চোখ দিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এক একটা গ্যালাক্সির বিভিন্ন অবস্থান সম্বন্ধে জেনেছেন। আবিষ্কৃত হয়েছে মহাশক্তিশালী গামা রে বার্স্ট বা গামা রশ্মির বিস্টেম্ফারণ।

মহাকাশের কিছু গ্যাসের কুণ্ডুলি সম্পর্কে এমনভাবে জানা গেছে, যেন তারা কিছু একটার ফাঁদে আটকা পড়ছে। যা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে। হাবল বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার বাতাসে শনাক্ত করেছে অক্সিজেনের উপস্থিতি। অ্যাডউইন হাবল প্রমাণিত সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ মাত্রা আবিষ্কার করেছে টেলিস্কোপটি। এ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ৬ হাজারেরও বেশি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ রচিত হয়েছে। হাবলে ব্যবহৃত হয়েছে ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩ (ভিপ৩) অ্যাডভান্সড ক্যামেরা ফর সারফেস (অঈঝ), স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকট্রোস্কোপ (ঝঞওঝ)। নিয়ার ইনফ্রারেট ক্যামেরা অ্যান্ড মাল্টি অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার (ঘওঈগঙঝ) ফাইন গাইড্যান্স সেন্সর। আর এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাবল প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বের নানা রহস্য ভেদ করে চলেছে।

টেলিস্কোপটি ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার আর স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট (ঝঞঝঈও)। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, টেলিস্কোপটি নাসা পাঠালেও এর ব্যবহার পৃথিবীর সবার জন্য উন্মোক্ত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো আগ্রহী ব্যক্তি বা মহাকাশ বিজ্ঞানী হাবলকে ব্যবহার করার অনুমতি চাইতে পারেন। প্রতি বছর এ রকম বহু আবেদন জমা পড়ে। একটি অভিজ্ঞ প্যানেল সেখান থেকে যোগ্যতমদের বাছাই করেন এবং আবেদন অনুযায়ী হাবলকে সেখানে ঘুরিয়ে সেখানকার ছবি তুলে সেই আগ্রহী ব্যক্তি, বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানীমহলকে পাঠান। ভবিষ্যতে হয়তো মহাবিশ্বের আরও অনেক অজানা তথ্য নিয়ে আসবে হাবল, যা কেবল আমাদের বিস্মিতই করবে না বরং মানব সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা সবাই সেই দিনগুলোর অপেক্ষায় আছি।-সমকাল

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে