এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : এই ফেলুদারা বুদ্ধিমান নন। বরং উল্টোটাই। এরা হলেন নন-পারফরমার। তাদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার চিঠির ধরন কেমন? লিখছেন অনিরুদ্ধ ধর। গোলাপি চিরকুট। যাকে মার্কিনিরা ভয়ে ভয়ে বলেন 'পিঙ্ক স্লিপ' নামে। ভয়ে ভয়ে কেন? বেশ তো সুন্দর রোম্যান্টিক সুন্দর এক নাম। আসলে রোম্যান্স যা, তা ওই নামেই। গোলাপি চিরকুট বড়োই বিপজ্জনক। এই চিরকুট হাতে এলেই 'কাম' খতম। আসলে এই 'পিঙ্ক স্লিপ' এক ধরণের কর্ম শেষের নোটিশ, যা পারসোনেল ডিপার্টমেন্ট পে- প্যাকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে যার হাতে দেন পরের দিন থেকে তাকে আর অফিসে আসতে হয় না। 'পিঙ্ক স্লিপ' হল আসলে ডিসচার্জ নোটিশ।
এ বিষয়ে বিশদে বলার আগে একটা সুখবর দিয়ে রাখা যাক। এ বছর গোড়ার দিকে কিন্তু চাকরির বাজার বেশ ভালো। বিভিন্ন সংস্থার নিয়োগকারীরা নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্যম্পাস প্লেসমেন্ট করার সময় চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো অফার দিচ্ছেন সবে পাশ করে বেরনো ছাত্রছাত্রীদের। একটা উদাহরন দিলেই বুঝতে পারবেন। চেন্নাই-এর গ্রেট লেকাস ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের এক ছাত্রকে 'অ্যামাজন ইন্ডিয়া' সংস্থা বছর পিছু পারিশ্রমিক দেবেন একান্ন লক্ষ টাকা। বিভিন্ন এইচ ফার্ম এ-বছর সমীক্ষা করে দেখছেন যে এবছর সাধারণ কর্মীদের মাইনে বাড়বে গড়ে শতকরা এগারো ভাগের কাছাকাছি। আর তারকা কর্মীরা পাবেন আরও বেশি। হিসেব বলছে শতকরা আঠারো ভাগ মাসোহারা বৃদ্ধি হবে স্টার পারফর্মারদের।
আলোর নিচেই যেমন থাকে অন্ধকার, তেমনই এই সুখবরের 'আদার সাইড অফ দ্য কয়েন' হল আরো বেশি লাভ করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা উঠে পড়ে লেগেছে কর্মী সংখ্যার মেদ কমাতে। এক সমীক্ষা অনুসারে টিসিএস এর মধ্যেই ২৬০০ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। আইবিএম এদেশে কর্মীসংখ্যা কমিয়েছে ৫০০০। অন্য বড় বড় সংস্থা এই পথেই পা রেখেছে। গত এক বছরে কেবল মাত্র বেঙ্গালুরুতে গোলপি চিরকুট হাতে পেয়েছেন ১৫০০০ হাজার আইটি কর্মী।
শুধুমাত্র আইটি সংস্থার মধ্যেই যে এই ছাঁটাই সীমিত তা নয়, বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এবং ম্যনুফ্যাকচারিং কোম্পানিও এই রাস্তা বেছে নিয়েছে। যে সমস্ত কর্মীরা ঠিকঠাক মানের কাজ করতে পারছেন না, তাদের আর না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইসিআইসআই এবং অ্যক্সিস ব্যঙ্কের মত সংস্থা। স্ট্যান্ডর্ড চাটার্ড ব্যাঙ্ক একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। 'র্যানস্ট্যাড ইন্ডিয়া' সংস্থার প্রেসিডেন্ট -স্টাফিং আদিত্য নারায়ন মিশ্র খরচ কমানোর এই ব্যপারটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, 'প্রতিটি সংস্থাই কর্মীদের অথবা তাদের কাজের ক্ষেত্র অপ্রয়োজনীয় মনে করে তাদের বাতিল করে দিচ্ছে'।
মুদ্রার এ-পিঠ এবং ও-পিঠ দেখলে স্পষ্ট যে কারও পৌষ মাস তো কারোও সর্বনাশ। একদিকে যেমন, কর্মক্ষেত্রে নতুন নতুন পদের সৃষ্টি হচ্ছে, সেইসব পদে নবাগতরা চমকে যাওয়ার মতো মাসহারা পাচ্ছেন। তেমনি অন্য দিকে নন পারফর্মররা হতে পাচ্ছেন পিঙ্ক স্লিপ। হাজারে হাজারে।
নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে এমন একটা বিপজ্জনক বস্ত্ত নাম হঠাত্ মার্কিনিরা পিঙ্ক স্লিপ রাখতে গেলেন কেন? নিউইয়র্ক টাইমসের একটা নিবন্ধ জানাচ্ছে র্যান্ডম হাউস, ডিকশানরির হিসেব মতো এই শব্দ জুটির অস্তিত্ব সেই ১৯১০ সাল থেকেই। কিন্তু কিবাবে কর্মশেষের এই শেষের এমন নামকরণ হল কেন? অনেকেই মনে করেন '..ডেভিল' হল এই নামের উত্স। যখন কোনও শো হঠাত্ করে ক্যানসেল করতে হত, তখন সেই শোয়ের নোটিশ দেওয়া হত গোলপি চিরকুটে লিখে। এর ভিন্ন একটা মতও আছে। সেটা হল কোনও ফর্ম পূরণ করার সময় তিনটে ভিন্ন রঙের পাতা ব্যবহার করা হয়, যার একটি গোলাপি। তবে যেকান থেকেই এই নাম আসুক না কেন, কোনও কর্মীই কিন্তু বাস্তবে ছাঁটাইয়ের নোটিশ গোলপি চিরকুটে পান না। টার্মিনাল স্লিপটিকে মার্কিনিরা বলেন 'পিঙ্ক স্লিপ'। ব্রিটেনে আবার এই পত্রটিকে বলা হয়, 'পি ৪৫', এবং বেলজিয়ামে বলা হয় 'সি ৪'।
স্লিপ হাতে পাওয়ার আগেই দেওয়াল লিখন পড়তে শিখুন
প্রায় সব বিশেষজ্ঞই একটা ব্যপারে একমত যে 'পিঙ্ক স্লিপ' হাতে পাওয়ার অনেক আগেই তার অশনি সংকেত পাওয়া যায়। কর্মীদের কেবল সেই সংকেতের সাংকেতিক ভাষা পড়তে জানতে হয়। সেই ভাষা পড়তে পারলেই এড়ানো যেতে পারে কর্ম ছুটির চিঠি। কেরিয়ার এক্সপার্ট ভিকি সালেমি একটি গ্রন্থ লিখে ফেলেছেন এই হুঁশিয়ারি নয়ে। বইটির নাম 'বিগ কেরিয়ার ইন দ্য বিগ সিটি'। তার মতে দেওয়াল লিখন পড়তে পারলেই কর্মীরা সহজে এড়িয়ে যেতে পারবেন 'পিঙ্ক স্লিপ' অথবা টার্মিনেশন লেটার পাওয়ার আগেই মান-সন্মান অটুট রেখে সংস্থা বদল করে যেতে পারবেন অন্য সংস্থায়।
তার মতে টারর্মিনেটেড হয়ে যাওয়ার পরে কিন্তু করার কিছুই থাকবে না। মুম্বাইয়ের নামী আইটি সংস্থায় চাকরি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। সংস্থার সিনিয়ার এইচআর ম্যানেজার তিনি। তার প্রথম সাবধানবানী হল, 'চোখ কান খোলা রাখতে হবে, অর্থাত্ নিজের রেটিং যদি বেশ কিছু দিন ধরে ওপরের দিকে না ওঠে, যদি ধীর গতিতেও নামতে থাকে, তাহলে সাবধান থাকাই ভালো। কারণ, কোনও সংস্থাই কম রেটিংয়ের কর্মীকে রাখতে চায় না।'
রেটিং নিম্নগামী ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি চিহ্নর ইঙ্গিত দিলেন তিনি, যা থেকে সহজেই কোনও কর্মী বুঝতে পারবেন সংস্থা তাকে ঠিক কোন চোখে দেখছেন, অর্থাত্ সংস্থায় তার গুরুত্ব কত। যেমন এতদিন আপনি যেই কাজ করতেন, হঠাত্ দেখতেন আপনার বস সেই দায়িত্ব অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন, তখনও আপনার বুঝে নেওয়া উচিত্ আপনাকে অচিরেই সরিয়ে দেওয়া হবে। এটি যেমন একটি গুরুত্বপূর্ন ইঙ্গিত 'পিঙ্ক স্লিপ' হতে পাওয়ার, তেমনই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হল, আগে যেখানে প্রতি মিটিংয়ে আপনাকে ডাকা হত, এখন আর ডাকা হচ্ছে না সেই সব ইন্টারনাল মিটিংয়ে। এরকম অবস্থা তৈরি হলে আপনাকে সাবধানী হতে হবে। আরো একটি ঘটনা যদি ঘটে তাহলেও আপনাকে চিন্তা করতে হবে আপনার চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে। সেই ঘটনাটি হল, আপনার নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জায়গা থেকে যদি আপনাকে বদলি করা হয় কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তাহলে বুঝতে হবে সংস্থা আপনাকে 'নন পারফর্মার' হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করে ফেলেছে।
এরকম অবস্থায় কী করা উচিত্ একজন কর্মীর? বিশেষজ্ঞেরা প্রথমেই একবাক্যে যেটা করতে বলছেন সেটা হল কর্মেক্ষেত্রে নতুন নতুন স্কিল শিখে ফেলা। ঠিক যেভাবে একটি কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড আপডেট করতে হয়, সেই ভাবেই একজন কর্মীকেও নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করে নিতে হয়। কারণ কয়েক বছর আগে যে স্কিল বা দক্ষতা নিয়ে আপনি চাকরিতে ঢুকেছিলেন সেই দক্ষতা কয়েক বছর বাদে আজ পুরোনও হয়ে গিয়েছে। ফলে কয়েক বছর বাদে কী হতে পারে সংস্থার কাজের চেহারা সেটা বুঝে নিয়ে নতুন নতুন কৌশল এবং কর্মপদ্ধতি শিখে নেওয়ার পরিকল্পনা করে নিতে হবে। নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া এইচ আর ম্যানেজার জানালেন 'এমন হলে সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে আপনার রেটিং কমে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে? যদি তিনি উত্তর এড়িয়ে যান তাহলে বুঝতে হবে আপনার অবস্থা সুবিধার নয়। আর যদি তিনি কোনও নতুন অনলাইন কোর্স করার সুপারিশ করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার মধ্যে উনি এখনও কিছুটা পোটেনশিয়াল তিনি লক্ষ্য করছেন।
তার মতে, রোজ আপনাকে দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে আপনি কী সংস্থার জন্য কাজে আসার যোগ্য? আপনার কী এই সংস্থায় বা অন্য কোথাও গ্রহনযোগ্যতা আছে? এখন সেই গ্রহনযোগ্যতা কীভাবে বুঝতে পারবেন? তিনি স্পষ্ট জানালেন 'প্রত্যেকেরই লুকিয়ে চুরিয়ে বাইরের সংস্থায় ফি-বছর দুটো কি একটা ইন্টারভিউ দেওয়া উচিত্। তাহলেই বোঝা সম্ভব আপনার এখনও বাজারে গ্রহনযোগ্যতা আছে কিনা। গ্রহনযোগ্যতা থাকলেই 'পিঙ্ক স্লিপ' পাওয়ার সম্ভাবনা দেখার সঙ্গেই অন্য সংস্থায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া উচিত্।
অর্থাত্ বোঝা যাচ্ছে কী করতে হবে। এক, নিজের রেটিং পড়ছে না উটছে সেটা স্পষ্ট বুঝে নিতে হবে। দুই, নিজের কর্মদক্ষতা আরো বিস্তৃত ও আপডেটেড করতে হবে। তিন আয়নার সামনে রোজই দাঁড়াতে হবে নিজেকে এবং বুঝতে হবে আপনি ডেলিবারেবল কী না। এবং চার, লুকিয়ে চুরিয়ে হলেও নিজের গ্রহনযোগ্যতা আছে কিনা সেটা বোঝার জন্য দু-একটা ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হবে। ভীতিগ্রস্ত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করলেই 'পিঙ্ক স্লিপ' কোনও সমস্যাই নয়।-এইসময়