মো. রোকুনুজ্জামান খান (সাগর): সুখ একটি আপেক্ষিক বিষয়, তবে জীবনে সুখী হতে কতজনই না কতকিছু করেন। একেকজনের কাছে সুখী হওয়ার সংজ্ঞাও ভিন্ন, কেউ হয়তো সুখী হওয়ার মানদণ্ডকে অর্থের সঙ্গে তুলনা করেন, কেউ আবার শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে মনে করেন তিনি সুখী।
অন্তত এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, সুখী হওয়ার সবচেয়ে উঁচু মানদণ্ড হলো শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। তবে মানুষ কীভাবে সুখী হন কিংবা সুখী হতে কী প্রয়োজর তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
এ বিষয় নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘ ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা চালিয়েছেন। ১৯৩৮ সালে এই গবেষণা শুরু করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। জেনে হয়ত অবাক হচ্ছেন যে, এত বছর কীভাবে গবেষণাটি চলমান ছিল।
এই গবেষণাকালে অনেক গবেষকরা মৃত্যুবরণও করেছেন। গবেষণাকাজের অর্থ যোগানেও সমস্যা হয়েছিল, নতুন গবেষক নিয়োগে সমস্যা’সহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তবে কিছু গবেষকের সক্রিয় ভূমিকায় গবেষণাটি দীর্ঘ বছর পর ফলাফলে পৌঁছায়।
কীভাবে গবেষণাটি করা হয়? এই গবেষণায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করেন একাধিক মানুষেরা। প্রথম দলে ছিলে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা কিছু ছাত্রছাত্রী। আর অন্য দলে ছিলেন, বোস্টন শহরের দরিদ্র পরিবারের (নমুনা দল) মানুষরা। ২/৩ বছর পরপর তাদের ডাটা নেওয়া হত।
এক্ষেত্রে তাদের মেডিকেল রিপোর্ট দেখা হত যে, স্বাস্থ্যগত (শারীরিক সুস্থতা) কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না রতাদের। এছাড়া ব্যাক্তিগত সাক্ষাৎকার ও পারিবারিক সাক্ষাৎকারও নেওয়া হত। এভাবে তাদের ডাটা সংগ্রহ করা হত। কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হত।
অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৪ সালে গবেষণাটি শেষ হয়। মানুষের মধ্যে তীব্র আকাঙ্খা জাগে কী পাওয়া গেছে সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে?
নমুনা দলে অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের দলে যারা ছিলেন তাদের প্রথম সাক্ষাৎকারে ৮০ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, অর্থ, ক্ষমতা ও ভালো অবস্থান মানুষকে সুখী ও পূর্ণ করে। তবে ফলাফলে উঠে আসে চমক! গবেষণা বলছে, ‘সুসম্পর্কই মানুষকে সুখী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে’। এই গবেষণা থেকে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানা যায় যেমন-
১. যাদের মধ্যে দৃঢ় সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তাদের শারীরিক সুস্থতার হার ছিল অনেক বেশি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল তারা ছিলেন ব্যক্তিজীবনে সুখী ও জটিল রোগমুক্ত।
অন্যদিকে যারা আত্নকেন্দ্রিক ও পারিবারিক কিংবা সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকেন তারা ব্যক্তিজীবনে একাকিত্ব ও মধ্যবয়সে গিয়ে নানান শারীরিক রোগে ভোগেন।
২. দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, গুণগত সম্পর্ক। আপনার সঙ্গে কতবেশি মানুষের সম্পর্ক আছে তার চেয়ে গুণগত সম্পর্কের সংখ্যা আপনার জীবনে কত বেশি তা বেশি জরুরি।
যাদের মধ্যে কোয়ালিটি সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তাদের মানসিক প্রশান্তি ছিল ও জটিল শারীরিক রোগ অনেক কম দেখা গিয়েছিলো।
৩. যাদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব ছিল মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায়, তাদের শারীরিক/ মানসিক রোগের পাশাপাশি মস্তিস্কের নানা ত্রুটি আছে।
মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের নিজেদের ভালো থাকার জন্যই কিন্তু জরুরি। সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সেটা সরাসরি শরীরে প্রভাব না ফেললেও মনে তার বিরুপ প্রভাব পড়ে।
মানসিক অশান্তি যদিও বাইরে থেকে দেখা যায় না। মানসিক অসুস্থতার পেছনে জোরালো কারণ সম্পর্কের অবনতি।
আমাদের যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেন বা যে কোনো সমস্যা থাকুক না কেন আশপাশের মানুষের সমর্থন, সহানুভূতি, আস্থা কিন্তু সঠিক পথ দেখাতে ও জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে সাহায্য করবে। তাই আশপাশের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত সবারই।
বর্তমানে সবাই কর্মব্যস্ত জীবন কাটান। ব্যস্ততা সবার জীবনেই আছে, তাই বলে ব্যক্তিগত, পারিবারি বা সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত করা উচিত নয় কারও।
কর্মব্যস্ততার খাতিরে অনেকে হয়তো নিজ পরবারকেও এখন ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না, এতে কিন্তু আপনারই ক্ষতি হচ্ছে। মনে রাখবেন ‘সুসম্পর্কই মানুষকে সুখী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে’।
লেখক: সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং প্র্যাক্টিশনার।