এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : হৃদয়েরও হৃদয় আছে এবং তাঁকেও বুকের পিঞ্জরে যত্ন করে আগলে রাখতে হয় ।
প্রতিবছর এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ বিশ্বজুড়ে প্রাণ হারায় হৃদরোগে। আর ৮২ শতাংশ মৃত্যু ঘটে নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশেও হৃদেরাগের চিত্র উল্লেখযোগ্য। প্রাপ্তবয়স্কদের ১৫ শতাংশ ভুগছে হৃদেরাগে। সাধারণ মানুষ হৃদেরাগ চিকিৎসা পুরোপুরি আওতায় নেই। ২০১০ সালে স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিনে দেখা যায়, হৃদেরাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে হৃদেরাগে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
গত সপ্তাহের বুধবার প্যারিসের জর্জ পম্পিদ্যু হাসপাতালে ১৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভবপর করেছেন। দীর্ঘ অস্ত্রোপচার শেষে এক রোগীর দেহে তাঁরা গবেষণাগারে তৈরি করা কৃত্তিম এক হৃদযন্ত্র বসাতে সক্ষম হয়েছে। ফ্রান্সেরই কারম্যাট গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে ওই কৃত্রিম হৃদযন্ত্রটি।
চিকিৎসক দলের সদস্য ক্রিশ্চিয়ান লাত্রেমউইলে জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচারের পর চার দিন কেটে গেলেও সুস্থই আছেন ওই রোগী, সাড়া দিচ্ছেন চিকিৎসায় এবং তাঁর শরীরের উন্নতিও হচ্ছে।
এর আগে মৃত মানুষের শরীর থেকে হৃদযন্ত্র নিয়ে অসুস্থ মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনের ঘটনা বহুবার ঘটেছে পৃথিবীতে৷ প্রকৃতপক্ষে এই প্রক্রিয়া বেশ প্রাচীন৷ নরম্যান শুমওয়ে নামে এক চিকিৎসক এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ষাটের দশকে৷ তাঁকেই বলা হত ‘ফাদার অফ হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট' বা হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের জনক৷ তবে তিনি এই প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেও প্রথম নিজ হাতে এই অস্ত্রোপচার কিন্তু করেননি৷ বরং তাঁর দেখানো পথে হেঁটে ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর লুই ওয়াশকানাস্কি নামে এক রোগীর উপর প্রথম সফলভাবে এই অস্ত্রোপচার করেন ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড নামে দক্ষিণ আফ্রিকার এক চিকিৎসক৷ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত।
তবে পেসমেকারের মতো কৃত্রিম হৃদযন্ত্র তৈরির কাজ এর আগে কখনও হয়নি৷এই প্রথম ফ্রান্সের বায়োকেমিক্যাল ফার্ম কারম্যাটে তৈরি হল কৃত্রিম হৃদযন্ত্র। উল্লেখ্য এর আগে যে সমস্ত কৃত্রিম হৃদযন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল, তা সাধারণত অল্পকালই ব্যবহার করা যেত। তবে এই হৃদযন্ত্রটি ৫ বছরের জন্য কাউকে জীবিত রাখতে পারবে। কারমেট গত সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স অথরিটি থেকে চারজন মানুষের উপর এই গবেষণা চালানোর অনুমতি পেয়েছে। কারমেট আশা করছে আগামী বছর শেষের দিকে মানুষের হৃদযন্ত্রের উপর তাদের এই গবেষণা শেষ হবে এবং ২০১৫ সাল নাগাদ তারা বাণিজ্যিকভাবে ডিভাইসটি ইউরোপে দিতে পারবে। এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র তৈরীতে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার থেকে এক লক্ষ আশি হাজার ইউরো খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রস্তুতকারক সংস্থা কারমেট, ভারতীয় হিসেবে যার খরচ প্রায় বারো থেকে আঠারো কোটি রুপি।
ইওরোপিয়ান অ্যারোনটিক ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস কোম্পানি এই হৃদযন্ত্রটিকে আরও উন্নত করে। এর ওজন ২ পাউন্ড যা একজন স্বাস্থ্যবান লোকের হৃদপিণ্ডের ওজনের তিনগুণ এবং এটা আসল হৃদপিণ্ডের মত পেশী সংকোচন করে ,এতে সেন্সর লাগানো আছে যা মানুষের চলাফেরার সাথে রক্তপ্রবাহের খাপ খাইয়ে নেয়। এর ভেতরের যে অংশ রক্তের সংস্পর্শে আসে সেই অংশে সিন্থেটিক পদার্থ না লাগিয়ে বভিন টিস্যু লাগানো হয়েছে যাতে রক্ত জমাট না বাঁধে।
এর আগেও কৃত্রিম হৃদযন্ত্রের ব্যবহার ছিল ৷ দীর্ঘস্থায়ী হৃদযন্ত্রের অসুখে যাঁরা ভুগতেন তাঁদের শরীরে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র বসানো হত৷ কিন্তু স্থায়ীভাবে তাঁদের শরীরে এই কৃত্রিম প্রতঙ্গ এতদিন স্থাপন করা যেত না ৷ কারম্যাট সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যাতে অসুস্থ ব্যক্তিকে বারে বারে অস্থায়ী হৃদযন্ত্র বসাতে না হয়, তার জন্য স্থায়ী হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় তাঁদের সংস্থা ৷ এছাড়াও যাঁদের হৃদযন্ত্র পুরোপুরি বিকল হয়ে গিয়েছে তাঁদের হৃদযন্ত্র দাতা (ডোনার) পাওয়ার জন্যও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত ৷ কৃত্রিম হৃদযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় রোগীদের সেই দীর্ঘ অপেক্ষারও অবসান হল ৷
যে রোগীর দেহে প্রথম কৃত্রিম হৃদযন্ত্র বসানো হল, তাঁর নাম প্রকাশ না করা হলেও হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্ত্রোপচার না করা হলে, বেশি দিন বাঁচতেন না তিনি ৷ কৃত্রিম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের পর হাঁটাচলা না করতে পারলেও আপাদত তাঁকে উঠিয়ে বসানো ও দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা ৷ তাঁদের লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ওই রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া ৷ তবে ওই কৃত্রিম হৃদযন্ত্রটিকে সচল রাখতে লিথিয়াম ব্যাটারির একটি বেল্ট পরে থাকতে হবে রোগীকে ৷ রোগী যে তাঁর শরীরে এই পরীক্ষামূলক অস্ত্রোপচার করতে দিয়েছেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছেন চিকিৎসক দলের প্রধান অ্যালেন কার্পেণ্টিয়ার ৷ জানিয়েছেন, রোগী হিসাবে তিনি সব দিক থেকে খুবই সহযোগিতা করেছেন ৷
কারম্যাটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্তমানে লক্ষাধিক রোগী আছেন যাঁদের এই মুহূর্তে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। অথচ ডোনার না থাকায় তাঁদের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছিল না ৷ কৃত্রিম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন কার্যকর হলে তাঁরা সকলে নতুন জীবন ফিরে পাবেন নিশ্চিতভাবেই ৷ প্রথম অস্ত্রোপচারটি সফল হওয়ায় এবার বাকি রোগীদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাঁদের দেহেও কৃত্রিম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের কাজ করা হবে শীঘ্রই ৷