এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : দীর্ঘ দিন ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পর্কে থাকে হাজারো স্মৃতির ‘জঞ্জাল’। তিক্ত মধুর একান্ত ব্যক্তিগত এই মায়ার জঞ্জাল ঠেলে হুট করেই কেউ বিচ্ছেদের ঘোষণা দিতে পারে না। দীর্ঘ একত্রবাস অথবা যৌথ স্মৃতির অংশীদারত্বে মায়া পড়ে যাওয়া অপর পক্ষকে হুট করে কখনো ‘না’ বলা যায় না। সঙ্গী কষ্ট পাবে বলে চলতে থাকে ভাবনার অবদমন। মানুষ ধরে নেয়, হয়তো সম্পর্কের আকাশ থেকে শিগগিরই কেটে যাবে কালো মেঘ।
মানুষ ভাবে, এই অবদমনের কোনো দরজা জানালা নেই, অনুভূতি আড়াল করা অনেক সহজ। কিন্তু গবেষণা বলছে, সম্পর্কের টানাপোড়েনকালের টালমাটাল অনুভূতির লক্ষণগুলো পারস্পরিক যোগাযোগের ধরনে ভালোভাবেই প্রকাশ পায়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রেকআপের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস আগে থেকেই মানুষের ভাষায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সজ্ঞানে সম্পর্কের সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে থেকেই এসব লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।
অবশ্য শুধু মানুষের মুখ দেখে ব্রেকআপের লক্ষণ আবিষ্কার বেশ কঠিন। তা ছাড়া ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশাধিকার না থাকা এবং দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ব্যাপার হওয়ায় এ নিয়ে গবেষণা করাও কিছুটা জটিলই বটে। সম্পর্ক কখনো পরিণতিতে পৌঁছাতে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ব্রেকআপের কারণগুলো বুঝতে হলে ব্যক্তির ব্রেকআপকালীন, এর আগে এবং পরের চলাফেরা কথাবার্তা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
প্রত্যক্ষভাবে কারও জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না হলেও, টুইটার, ফেসবুক এবং রেডিটের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কগুলো নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব করে তুলেছে। কারণ, মানুষ এখন দৈনন্দিন জীবন এসব প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করছেন। এতে তাঁরা ব্রেকআপের আগে এবং পরে জীবনের উত্থানপতন কীভাবে মোকাবিলা করেন তা গবেষকেরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। মানুষের নিত্যদিনের ভাষা বিশ্লেষণ করলে তাঁদের পরিবর্তনশীল অনুভূতি, চিন্তার ধরন এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ধরন সম্পর্কে জানা যায়।
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রেডিট এক ধরনের অনলাইন অবকাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে মানুষ বাস্তব জীবনে কীভাবে সামাজিকতার চর্চা করে তার প্রতিফলন দেখা সম্ভব।
সাব–রেডিট নামে রেডিটে হাজার হাজার গ্রুপ রয়েছে, যেখানে টেনিস থেকে শুরু করে রাজনীতি, গেমিং থেকে শুরু করে বুননের মতো ভিন্ন ভিন্ন আগ্রহের বিষয় ভেদে মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিনিময় রক্ষা করে। এতে সমমনা ব্যক্তিরা একসঙ্গে আড্ডা দিতে পারেন, নিজের আগ্রহের বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারেন এবং পরামর্শ নিতে পারেন।
গবেষকেরা আর/ব্রেকআপস নামের একটি সাব–রেডিট পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ গ্রুপটিতে মানুষ সম্পর্কের ভাঙন নিয়ে আলোচনা করে। এ ধরনের ৬ হাজার ৮০৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি গ্রুপের ব্রেকআপ সম্পর্কিত পোস্ট এক বছর ধরে বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষকেরা শুধু ব্রেকআপের আগের ও পরের পোস্টই বিশ্লেষণ করেননি, ওই সময়ে পোস্টগুলোতে তাঁদের ভাষাও বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকেরা বের করার চেষ্টা করেছেন, যখন ব্রেকআপের কথা সরাসরি বলা হয়নি, তখন কথায় আসন্ন ব্রেকআপের কোনো নিদর্শন বা ইঙ্গিত ছিল কি না।
১০ লাখেরও বেশি পোস্ট বিশ্লেষণ করার পর গবেষকেরা লক্ষ্য করেন, ব্রেকআপের তিন মাস আগে থেকে মানুষের ভাষায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। অর্থাৎ সঙ্গীর ভাষাভঙ্গি দেখে তিন মাস আগেই আসন্ন ব্রেকআপ টের পাওয়া সম্ভব। ভাষার এ পরিবর্তন ব্রেকআপের ছয় মাস পর পর্যন্তও থাকে।
সম্পর্ক নিয়ে কথা না বললেও এ পরিবর্তনগুলো ভাষায় লক্ষ্য করা যায়। পোস্টগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, পোস্টদাতা খেলা, রান্না বা ভ্রমণ নিয়ে পোস্ট করলেও তাঁদের ভাষায় সে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান থাকে। কখনো কখনো পোস্টদাতা নিজেও তাঁর সম্পর্কের আসন্ন সমাপ্তি নিয়ে সচেতন থাকেন না। তবে এরই মধ্যে আসন্ন এ পরিণতি অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ধরনকে প্রভাবিত করা শুরু করে।
ভাষা বদলায় যেভাবে
আসন্ন বিচ্ছেদের বড় একটি লক্ষণ হলো, নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়া। কথায় ‘আমি, আমার’ জাতীয় শব্দ বেড়ে যায়। জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বা সংকটপূর্ণ মুহূর্তেই মানুষের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতা বা উদ্বেগের সময় আত্মকেন্দ্রিক ভাষার ব্যবহার বেড়ে যায়।
এ সময়টায় মানুষের ভাষায় বিশ্লেষণমূলক চিন্তার ঘাটতি দেখা যায়। বিশ্লেষণমূলক চিন্তা প্রক্রিয়া যৌক্তিক চিন্তা ভাবনার সঙ্গে জড়িত। বিচ্ছেদের পথে থাকা মানুষের ভাষা অস্বাভাবিক ও ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে। তাঁদের আলোচনা ধারণাকেন্দ্রিক না হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।
ব্রেকআপের সময়টাতে মানুষ সঙ্গীকে নিয়ে তুলনামূলক বেশি আলোচনা করে। কারণ, তখনো নিজের অস্তিত্বকে সঙ্গী থেকে আলাদা করতে পারে না। হৃদয় ভাঙার পর মানুষ কঠিন এ সময়ে যারা পাশে আছে তাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে।
ব্রেকআপের সময় মানুষের চিন্তাশক্তিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তাঁরা সম্পর্কের বোঝাপড়া নিয়ে নিজের বুঝজ্ঞানকে প্রশ্ন করা শুরু করে, আর বোঝার চেষ্টা করে, কেন এ সম্পর্ক ভেঙে গেল।
সময় যত গড়াতে থাকে, মানুষ ব্রেকআপ নিয়ে তত সুসংগঠিত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো শুরু করে। এতে তাঁদের যৌক্তিক চিন্তা প্রক্রিয়া আবার সচল হওয়া শুরু করে। তখনই তাঁরা জীবনের পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে।
গবেষণাটির আওতাধীন মানুষের ভাষা আবার স্বাভাবিক হতে ছয় মাসের মতো সময় লেগেছিল। অবশ্য একে স্থায়ী অবস্থা বলা যায় না। কারণ শোক কাটিয়ে ওঠার বিষয়টি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কোনো শব্দ, রং, ঘটনা, ব্যক্তি বা বস্তু পুরোনো স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। ফলে হুটহাট ব্রেকআপের শোক জেঁকে বসাটা অস্বাভাবিক নয়!