এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : মানুষের ভ্রূণে জিনগত পরিবর্তনে কাজ শুরু করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। প্রথমবারের মতো তারা মানুষের ভ্রূণে জিনগত একটি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। রক্তের সমস্যার জন্য দায়ী একটি জিন ভ্রূণ থেকে সরিয়ে ফেলতে বিতর্কিত একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন তারা।
এ শতকের বায়োটেকনোলজির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হবে জন্মের আগেই ঠিকঠাক করে রাখা বা নকশা করে রাখা শিশু ও সম্পাদনা করা মানুষের জন্মের ঘটনা। নকশাকৃত এ ধরনের শিশু হবে দারুণ চটপটে, রোগমুক্ত, শারীরিকভাবে দক্ষ। এই শিশু যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির শিশুদের মতো হবে, তা না বললেও চলছে। মানুষের জন্মের সময় জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নিখুঁতভাবে তাকে তৈরি করার কাজ কি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে? প্রযুক্তি ও ব্যবসা বিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডারে উঠে এসেছে সেই তথ্য।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকেরা বলছেন, নকশা করা শিশু তৈরি সম্ভব। কিন্তু এখনো মানব ভ্রূণ সম্পাদনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি শতভাগ নিখুঁত নয়। কিন্তু উন্নয়নের প্রক্রিয়া থেমে নেই। ইঁদুর ও বানর নিয়ে গবেষণা করে সফলতা এসেছে। আগামী এক থেকে দুই দশকের মধ্যেই রোগমুক্ত বা সম্পাদনা করা শিশু আমরা দেখতে পাব।
নৈতিক বিতর্ক
চীনা বিজ্ঞানীদের মানব ভ্রূণ নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা থেকে সরে আসতে বলছেন গবেষকেরা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একদল গবেষকের দাবি, বিতর্কিত যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে মানব ভ্রূণে জিনগত পরিবর্তন করা হচ্ছে, তা নিরাপদ কি না বা প্রযুক্তিগত কোনো ত্রুটি আছে কি না, সে প্রভাবগুলো খতিয়ে দেখার আগ পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণা করা ঠিক হবে না। তারা বলছেন, বিশেষ জার্ম লাইন প্রক্রিয়ায় জিনগত যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে তা বিপজ্জনক ও নৈতিকতাবিরোধী। এই পদ্ধতিতে মানুষকে তাঁদের কাক্সিক্ষত বা ইচ্ছানুযায়ী সন্তান নিতে উৎসাহী করবে। মানুষ তাঁদের কাক্সিক্ষত জিনগুলোই কেবল ভ্রূণের মধ্যে চাইবে। এতে কেবল ‘নকশা করা’ শিশু জন্ম দেয়ার প্রবণতা বাড়বে।
কিছু গবেষক এ ধরনের গবেষণার ফল অনৈতিক কাজে ব্যবহারের আশঙ্কা করলেও কিছু গবেষক মনে করছেন ক্যানসারের মতো কিছু রোগের চিকিৎসায় এ ধরনের গবেষণা কাজে লাগানো যাবে।
নেচার সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের গুয়াংজুর সান ইয়েতসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা প্রোটিন অ্যান্ড সেল সাময়িকীতে গবেষণা সংক্রান্ত নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। গবেষণা কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন গবেষক জুনজিউ হুয়াং।
গবেষক জুনজিউ দাবি করেছেন, অকার্যকর ভ্রূণ ব্যবহার করে তারা এই গবেষণা করেছেন যা শিশু হিসেবে জন্ম নিতে সক্ষম নয়। রক্তের সমস্যা বা বেটা-থ্যালাসেমিয়া তৈরির জন্য দায়ী জিনটিকে সিআরআইএসপিআর/ক্যাস ৯ নামের পদ্ধতিতে সম্পাদনা করা হয়েছে। এতে জিনের নির্দিষ্ট অংশ পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হয়।
গবেষকেরা মোট ৮৬টি ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা চালান। এতে ৭১টি জিন টিকে যায়, যার মধ্যে ৫৪টি ভ্রূণ পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু এই পরীক্ষায় সফলতা আশানুরূপ হয়নি।
গবেষক হুয়াং জানিয়েছেন, সাধারণ মানব ভ্রূণের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করতে গেলে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তবেই পরীক্ষা করতে হবে। তাই পরীক্ষা থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
নকশাকৃত শিশু কি দোড় গোড়ায়?
জেনেটিকসের উন্নতির ফলে শতভাগ দক্ষতার সঙ্গে নকশাকৃত শিশু পাওয়া সম্ভব। ইঁদুরের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রায় শতভাগ আকাঙ্ক্ষিত সফলতা মিলেছে বলে এক গবেষক দাবি করেছেন।
যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ড. টনি পেরি সতর্ক করে বলেছেন, আমাদের সমাজকে নির্দিষ্ট নকশা করা সন্তানসন্ততিকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, সম্প্রতি গবেষকেরা সিআরআইএসপিআর পদ্ধতিতে জিনগত ফুসফুস সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। এই পদ্ধতিতে জিনের নির্দিষ্ট অংশ সম্পাদনা করে কাঙ্ক্ষিত শিশু পাওয়া সম্ভব।
শিশু জন্মের আগে তার জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নির্দিষ্ট বা আকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে এই পদ্ধতিটি নিষিদ্ধ নয়।
মানব ভ্রুণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটানোর পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন গবেষক। চীনের সাংহাই টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ইতিমধ্যে বানরের ভ্রূণের জিনগত পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছেন। এখন মানব ভ্রূণের ক্ষেত্রে পরীক্ষা চালানোর অনুমতির অপেক্ষায় আছেন গবেষকেরা।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ জর্জ চার্চও মানব ভ্রূণ রূপান্তর করার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর চিকিৎসার সময় অপরিণত ডিম্বাণু কোষ ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন।-টেলিগ্রাফ