আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আইনস্টাইন বেজায় চটেছিলেন এর পেছনের কারিগরদের ওপর। বিশেষ করে নিলস বোর ও তাঁর শিষ্যদের ওপর। কারণ, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত আইন। সেসব আইন মানতে পারেননি আইনস্টাইন।
তাই একের পর এক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গবেষকদের ওপর কথার কামান দাগেন তিনি। এরই জেরে একদিন রেগেমেগে বলেছিলেন, ‘যখন আমরা তাকিয়ে থাকি না, তখন আকাশে কি চাঁদটা থাকে না?’
কেন বলেছিলেন আইনস্টাইন এমন উদ্ভট কথা? আসলে তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার তত্ত্বকেই আঘাত করতে চেয়েছিলেন। অথচ কোয়ান্টাম তত্ত্ব তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম দেন।
কিন্তু সেটা পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠা পায়নি। আইনস্টাইন সেটাকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯০৫ সালে। তারপর থেকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বে এসেছে অবিশ্বাস্য গতি। নিলস বোর, উইলিয়াম সমারফেল্ড, ম্যাক্স বর্ন, লুই দ্য ব্রগলি, সত্যেন বসুদের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
কিন্তু সত্যিকারের যেটা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় ডেনিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর ও তাঁর শিষ্য ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, পল ডিরাক, উলফগ্যাং পাউলি, এনরিকো ফার্মিদের হাত ধরে।
কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যত অদ্ভুতুড়ে আইন, সেগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ভেতর থেকে। এই তত্ত্বের সার কথা হলো, অতি পারমাণবিক জগতে বস্তুকণাদের আচরণ বিস্ময়কর।
বস্তুকণাদের ভরবেগ আর অবস্থান একসঙ্গে মাপা যায় না। ভর মাপতে গেলে অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আর অবস্থান ঠিকঠাক জানার চেষ্টা করতে গেলে ভরবেগ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
লুই দ্য ব্রগলি বলেছিলেন, প্রতিটি বস্তুর তরঙ্গ ও কণা দুই ধর্মই আছে। বস্তু যত বড় হয়, তত এর তরঙ্গ ধর্ম কমে যায়, একেবারে শূন্য হয় না। অন্যদিকে বস্তু যত ছোট হতে থাকে, তার তরঙ্গ ধর্ম তত বাড়ে। অতি পারমাণবিক কণাদের ক্ষেত্রে বস্তুর তরঙ্গ ধর্ম প্রবল হয় সবচেয়ে বেশি।
তাই ইলেকট্রন কিংবা কোয়ার্কের মতো কণাদের ঢালাওভাবে কণা বললে চলবে না। এরা একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ।কিন্তু কখন আপনি বস্তুকে কণা আর কখন তরঙ্গরূপে দেখবেন? অনিশ্চয়তা নীতি এই প্রশ্নটাকেই ছাইচাপা আগুনের মতো করে উসকে দেয়, দেয় এক অদ্ভুত সমাধান। সেই সমাধান বলে, কণারা আসলে কণাই নয়, আবার ঠিকঠাক তরঙ্গও নয়।
এরা কখন কীরূপে থাকবে, তা নির্ভর করে আপনার ওপর। আপনি কণাদের ওপর যদি গোয়েন্দাগিরি করতে চান, তাহলে হতাশ হতে হবে। এরা আপনাকে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ধোঁকা দেবে। কণারা চতুর! তাহলে এদের কি বুদ্ধি আছে? মন আছে? জীবন আছে?না কণাদের মন, বুদ্ধি, জীবন কোনোটিই নেই। আছে অদ্ভুত আচরণ।
ধরুন আপনি একটা কণার পেছনে লাগলেন সেটার চরিত্র ঠিকঠাকভাবে জানার জন্য। এ জন্য আপনার দুই ধরনের যন্ত্র লাগবে। আপনি যদি এর তরঙ্গ ধর্ম দেখতে চান, তাহলে এমন একটা যন্ত্র লাগবে যেটা কণাদের তরঙ্গ ধর্ম শনাক্ত করতে পারে। আর যদি এর কণা ধর্ম জানতে চান, তাহলে এমন এক যন্ত্র লাগবে, যেটা কণা ধর্ম শনাক্ত করতে পারবে।
কিন্তু মুশকিল হলো, আপনি হয়তো কণা ডিটেক্টর দিয়ে কণাটিকে দেখতে চাইছেন, তখন সেটা কণা অবস্থায় না-ও থাকতে পারে। আবার আপনি হয়তো তরঙ্গ ডিটেক্টর দিয়ে এর তরঙ্গ ধর্ম দেখতে চাইছেন, তখন এটা হয়তো কণা অবস্থায় আছে। তখন কী হবে? কণা ডিটেক্টরে এদের সম্বন্ধে তাহলে কিছুই জানতে পারবেন না?
অনিশ্চয়তার দাবিদার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটা কখনোই হবে না। যখন কণা ডিটেক্টর দিয়ে দেখবেন, তখন কণাদের আপনি কণা হিসেবেই পাবেন।
আবার যখন তরঙ্গ পরিমাপক দিয়ে দেখতে যাবেন, তখন একে তরঙ্গ হিসেবেই পাবেন। অর্থাৎ কণারা তরঙ্গ নাকি কণা, সেটা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের ওপর। পর্যবেক্ষক একে কী হিসেবে দেখতে চাইছেন, কণারা সেই হিসেবেই নিজেদের দেখাবে।
এ কথা শুনেই আসলে আইনস্টাইন চটেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর নিশ্চয়ই পাশা খেলা করেন না।’
এ কথায় ইটের বদলে পাটকেলটিই খেতে হয়েছিল আইনস্টাইনকে। সেটা ছুড়েছিলেন নিলস বোর। বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর কী করবেন না করবেন, সেটা আপনাকে বলে দিতে হবে না।’
কিন্তু মাইক্রোস্কোপিক জগতে কণাদের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী?
আসলে কণারা একই সঙ্গে কণা আর তরঙ্গ হিসেবে থাকে বলে যখন একে আপনি কণা ডিটেক্টর দিয়ে দেখতে যাচ্ছেন, তখন সেটা কণা হিসেবেই নিজেদের জাহির করছে।
অন্যদিকে যখন তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে দেখতে চাইছেন, তখন এটা তরঙ্গ হিসেবেই নিজেদের জাহির করছে। এটা একটা ব্যাখ্যা।
কিন্তু খুদে কণিকারা একই সঙ্গে কণা আর তরঙ্গ হিসেবে কেন থাকে? এদের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণই-বা কী? অনেক রকম ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। কিন্তু শেষমেশ ওই ধোঁয়াশার চাদরেই নিজেদের বন্দী করে রেখেছে কোয়ান্টাম কণারা।