এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং জাপানের কিছু সাধু ছিল যারা তাদের সাধনার অংশ হিসেবে নিজেদের জীবন্ত অবস্থায় মমিতে পরিণত করতেন। প্রাচীন ভারতে বৈষ্ণব ধর্মাবলি সাধু সন্ন্যাসীদের একটা অংশকে মহাদেব নামে ডাকা হতো। এই মহাদেব সাধুরা এই সাধনাকে ‘বৃন্দাবনে প্রবেশ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে পালন করতেন।
জৈন রীতিতেও সাল্লেখানা নামে প্রায় একই ধরনের একটা সাধনা ছিল, সেখানে একজন সাধু আমৃত্যু উপোস করে থাকতেন। বিশ্বাস করা হতো এতে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা যায় এবং সহজে স্বর্গে যাওয়া যায়।
তবে প্রাচীন তিব্বত, চীন এবং জাপানে সিনগন নামের বৌদ্ধ সাধুরা নিজেরাই জীবিত অবস্থায় নিজেদের মমিতে পরিণত করতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সিনগন গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা কুকাই চায়নার ট্যাং প্রদেশে প্রথম এই জীবিত মমি হওয়ার রীতি চালু করেন। তাদের কাছে এটা ছিল পবিত্র আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের এক সম্মানিত পন্থা। যারা এই কাজে সফল হতেন, তাদের বলা হতো ‘সকোশিবাতসু’।
জাপানের হনসু দ্বীপের তহকু নামের সাধুরা এই সাধনা করতেন। নিজেদের মমি বা জীবনামৃত করার যে রীতি ভারতীয় সাধুরা অনুসরণ করতেন তার সঙ্গে এই চৈনিক ও জাপানি সাধুদের খুব বেশি একটা মিল ছিল না। মিল বলতে এইটাই ঈশ্বরের তুষ্টির জন্য নিজের শরীরকে উৎসর্গ করা।
একজন সাধুকে একজন সফল ‘সকোশিবাতসু’ হওয়ার জন্য মোট দশ বছরের একটি কঠিন সাধনার মধ্য দিয়ে যেতে হতো এবং সর্বশেষ ধাপে তিনি নিজেই জীবিত অবস্থায় নিজেকে একটি কবর সমতুল্য ছোট্ট গুহায় প্রবেশ করাতেন এবং সেখানেই তিনি মারা যেতেন। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় এটা অনেক সম্মানের এবং গৌরবের একটি বিষয় ছিল।
‘সকোশিবাতসু’ সাধনার প্রথম ধাপটি ছিল তিন বছরের। এই ধাপে সাধুরা তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা শিখতেন। এ জন্য তারা তাদের খাদ্যাভাস সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে ফেলতেন। তাদের খাদ্য তালিকায় থাকত শুধু অল্প কিছু বাদাম এবং ফল জাতীয় খাবার। এই ধরনের খাদ্য নিয়ন্ত্রণে শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় চর্বি ঝরে যেত। পরের তিন বছর তারা বিশেষ কিছু গাছের ছাল এবং কিছু নির্দিষ্ট গাছের মূল খেতেন যার মাধ্যমে তারা তাদের শরীরের অতিরিক্ত আর্দ্রতা বের করে দিতেন যাতে মমি বানাতে সুবিধা হয়। উল্লেখ্য, মমি বানানোর জন্য আর্দ্রতা কম থাকা বাঞ্ছনীয়। আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে শরীর দ্রুত ক্ষয়ে যাবে এবং মৃত্যুর পর তা দিয়ে ভালো মমি বানানো যাবে না। সাধুরা এই তিন বছর খুব নিয়মকানুন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণে থাকতেন। তারা খাবারের পরিমাণ আগের চাইতে আরো কমিয়ে দিতেন এবং বেশি বেশি পরিশ্রমের কাজ করতেন যেন শরীরে অবশিষ্ট বাকি চর্বিগুলোও দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়।
‘সকোশিবাতসু’ সাধুরা তাদের সাধনার শেষ পর্যায়ে এসে বেশ কিছু অদ্ভুত কাজ করতেন, যেমন শরীর থেকে দ্রুততার সঙ্গে পানি বের করে দিতে তারা ‘বমি’ করতেন। উরশি নামের গাছের ছাল দিয়ে এক বিশেষ প্রকার চা বানিয়ে খেতেন। এই হার্বাল চা ছিল কিছুটা বিষাক্ত। এই চা পান করলে একজন মানুষের প্রচুর বমি হয় এবং শরীর খাবার থেকে কোনো চর্বি গ্রহণ করত না। আধুনিককালে যে বিশেষ হার্বাল চা পানের মাধ্যমে মানুষ ওজন কমায় তা সেই উরশি গাছের ছাল থেকেই প্রস্তুত। এই জাতীয় বিষাক্ত চা পানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির শরীরে কোনো প্রকার ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু সহজে বাসা বাঁধতে পারে না, ফলে মৃত্যুর পর সহজে দেহ ক্ষয় হয় না।
ছয় বছর এই ধরনের কঠিন সাধনার পরে একজন সাধুর শরীরে হাড্ডি ছাড়া আর তেমন কিছু থাকে না। এই পর্যন্ত যদি কোনো সাধু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তাহলে তিনি পরের ধাপে প্রবেশ করেন। এই ধাপে একজন সাধু নিজেই নিজের পছন্দমতো একটি ছোট পাথুরে কবর বেছে নেন বা প্রস্তুত করেন যেখানে শুধু খাপে খাপে তারই জায়গা হবে। এই কবরে প্রবেশ করে সাধুরা পদ্মাসন গেড়ে বসেন। একবার এভাবে আসন গ্রহণ করার পর মৃত্যুর পূর্বে তিনি কোনো ভাবেই সেই কবর বা সেই স্থান ত্যাগ করতে পারবেন না।
একজন সাধু কবরে আসন গ্রহণ করার পর তার কবরটি পাথর বা মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। কবরে একটা বিশেষ ফাঁপা বাঁশ থাকত যা দিয়ে ওই সাধু নিশ্বাস নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বাতাস পেতেন এবং প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওই বাঁশের সঙ্গে আটকানো একটা ঘণ্টা বাজাতেন যেন অন্য সহসাধুরা বুঝতে পারেন তিনি বেঁচে আছেন।
যেদিন থেকে ঘণ্টার শব্দ আর শুনতে পাওয়া যেত না, ধরে নেয়া হতো তিনি দেহত্যাগ করেছেন। তখন সেই বাঁশটি তুলে ফেলে ঘণ্টাটিকে মন্দিরে স্থাপন করা হতো এবং সেই কবরটিকে পুনরায় মাটিচাপা দেয়া হতো। কথিত আছে কোনো কোনো সাধু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেল বাজিয়ে যেতেন। তবে এ ব্যাপারে কোনো আক্ষরিক দলিল পাওয়া যায়নি। এই পর্যায়ে এসে অন্য সাধুরা ১০০০ দিনের একটি ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ পালন করতেন এবং ১০০০ দিন পর তারা কবর খুঁড়ে দেখতেন আসলেই ওই সাধুটি মমি হতে পেরেছেন কি-না। যদি কবর খুঁড়ে দেখা যেত, সাধুটি মমিতে পরিণত হয়েছেন তখন তার মমিকে মন্দিরে দর্শনার্থীদের জন্য স্থাপন করা হতো এবং তাকে বুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করে তার প্রতি সবাই সম্মান স্থাপন করত।
জাপানের ইয়ামগটা (ণধসধমঃধ) প্রদেশে প্রায় এক হাজারের বেশি সাধু এই সাধনা করেছেন তার মধ্যে মাত্র ২৪ জন সফল হতে পেরেছেন। উল্লেখ্য, এখানে অনেক ভারতীয় সাধুও ছিলেন যারা পুণ্যাত্মার সন্ধানে তিব্বত, চীন এবং জাপানে দীক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। ১৮শ’ শতাব্দীর শেষের দিকে জাপান সরকার জীবিত মমি হওয়ার এই ধার্মিক রীতিকে ধার্মিক আত্মহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।