এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : বার্গারের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুজব। জনপ্রিয় এই গুজব এমনভাবে ছড়িয়েছে, এর ভেতর থেকে সত্য খুঁজে বের করা কঠিন।
গল্পটা এমন, ১৯০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাভেনের এক হোটেলে এক ব্যক্তি দুপুরের খাবার খেতে যান। কিন্তু তাঁর হাতে খুব বেশি সময় ছিল না। তিনি এমন কিছু চাইছিলেন, যেন লাঞ্চ নিয়েই বের হয়ে যেতে পারেন। পথে যেতে যেতে লাঞ্চটা সহজেই সেরে ফেলতে পারেন।
আউটলেটের মালিক লুই ল্যাসেন দুই টুকরা ব্রেডের মাঝখানে রেস্তোরাঁর স্টেকের একটি প্যাটি দিয়ে নতুন কিছু করে ফেললেন। আগের থাকা খাবার মেনু জোড়াতালি দিয়ে ‘ইম্প্রোভাইজ’ করলেন। এভাবে আবিষ্কার হলো ক্যারিআউট লাঞ্চ। মানুষ পেল চলার পথে দুপুরের খাবার সেরে ফেলার আইডিয়া। বিশ্ব পেল হ্যামবার্গার স্যান্ডউইচ।
বার্গার আর হ্যামবার্গারের পার্থক্য আছে। মূল পার্থক্য প্যাটিতে। হ্যামবার্গারের ভেতরে থাকে বিফ প্যাটি। আর অন্য বার্গারের ভেতরের পেটি অনেক রকম হয়। মুরগি, টার্কি, ল্যাম্ব থেকে শুরু করে হালের ভেগানদের ব্রকলি প্যাটি পর্যন্ত। এগুলো ‘ইম্প্রোভাইজড’। মূল বার্গারের গল্পে পাওয়া যায় হ্যামবার্গার।
হ্যামবার্গার আবিষ্কারের এ গল্পটি সবখানে ছড়িয়ে আছে। বইপত্রে বা পত্রপত্রিকায় গল্পটি বহুবার লেখা হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের একজন লেখক প্রমাণ পেয়েছেন, বার্গার আবিষ্কারের গল্পটি সত্য নয়। যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খাবারের দোকানে হ্যামবার্গার বিক্রি হতো।
১৮৯৪ সালের বসন্তকালে টেক্সাসের শাইনার গেজেটে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যেটি ছিল একটি স্থানীয় সেলুনে পরিবেশিত ‘হ্যামবার্গার স্টেক স্যান্ডউইচ’–এর বিজ্ঞাপন।
ওয়াশিংটন পোস্টের লেখক এরিক অফগ্যাগ গভীর অনুসন্ধান করে দেখেছেন, ১৮৯০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, ইলিনয়, আইওয়া, নেব্রাস্কা, নেভাদা, নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া এবং হাওয়াইসহ অনেক শহরে হ্যামবার্গারের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি ছিল। এক ডজনের বেশি সংবাদপত্রে এর সূত্র পাওয়া গেছে। এভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, ১৯০০ সালের গল্পটি অসত্য।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে প্রচলিত আছে, বার্গার আবিষ্কার করেন চার্লি নাগ্রিন। যিনি ১৮৮৫ সালের টেক্সাসের এথেন্সের সেমুরে একটি মেলায় ব্রেডের দুই টুকরার মধ্যে একটি মিটবল ঢুকিয়ে বিক্রি করেছিলেন। আবার ফ্লেচার ডেভিসকে ‘হ্যামবার্গার স্রষ্টা’ উপাধি দেওয়া হয়। যিনি ১৮৮০–এর দশকে নাকি এটি আবিষ্কার করেন। নিউইয়র্ক, ওকলাহোমা এবং অন্যান্য জায়গায় বার্গারের উদ্ভাবন নিয়ে এমন গল্প ছড়িয়ে আছে, তবে প্রমাণ মেলেনি।
জানা গেছে, ব্রেডের ভেতরে কাটা মাংস রেখে পরিবেশনের ধারণা প্রায় সভ্যতার মতোই প্রাচীন। লেখক অ্যাপিসিয়াসের খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর রোমান আমলের রান্নার বইয়ে (কুক বুক) একটি রেসিপি আছে।
সন্দেহ করা হয়, এটি আধুনিক বার্গারের কাছাকাছি কিছু একটা হবে। কিমা করা মাংসের প্যাটিতে বাদামের গুঁড়া মিশিয়ে প্রচুর মসলা দিয়ে রান্না করা হতো। এ তথ্য খুঁজে বের করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক জর্জ মোটজ। বার্গারের ইতিহাস নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা করেছেন।
১৭০০–এর দশকের মাঝামাঝি হান্না গ্লাসের ‘দ্য আর্ট অব কুকারি, মেড প্লেইন অ্যান্ড ইজি’তে একটি ‘হ্যামবার্গ সসেজ’ রেসিপি আছে। টোস্ট করা ব্রেড দিয়ে এই সসেজ পরিবেশন করা হয়। ১৮৬৯ সালের মধ্যে কোনো এক সময় জার্মানিতে রুন্ডস্টুক ওয়ার্ম নামে একধরনের খাবার জনপ্রিয় হয়েছিল, যেটি মূলত ব্রেডের ওপর একটি মাংসের প্যাটি।
এখন আমরা যে বার্গার চিনি, এটি ১৮৭০ সালের শুরুর দিকে আমেরিকায় একটি সস্তা মেনু হিসেবে প্রচলিত হয়। কিমা করা মাংসের প্যাটি থাকে বার্গারে। এর নাম ছিল হ্যামবার্গার স্টেক। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্ক সিটির ডেলমোনিকোর একটি মেনুতে এই খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই হ্যামবার্গার কিমা করা গরুর মাংস আর পেঁয়াজ সহযোগে একটি প্লেটে পরিবেশন করা হয়েছিল। ব্রেড ছিল না। তখন মাংস হাত দিয়ে কিমা করা হতো। ১৮০০–এর দশকের শেষের দিকে গ্রাইন্ডার সহজলভ্য হয়। তখন হ্যামবার্গারে কিমা মাংস যেমন ছিল, স্টেকের প্যাটিও ছিল। ১৮৮০ সালের দিকে এই হ্যামবার্গার আমেরিকার সবখানেই রেস্তোরাঁগুলোতে পাওয়া যেত। মাঝেমধ্যে এই স্টেক দুই পাশে ব্রেড দিয়ে পরিবেশন করা হতো।
এভাবে হ্যামবার্গার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৮৭ সালে নিউইয়র্কের একটি লজিং হাউস ১০ সেন্টে ‘এক বাটি কফি, হ্যামবার্গার স্টেক এবং ব্রেডের’ বিজ্ঞাপন প্রচার করে। কয়েক বছর পর ১৮৯১ সালে বোস্টন গ্লোব পত্রিকা একটি কসাইয়ের দোকানের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বিজ্ঞাপনে ‘টোস্ট করা হ্যামবার্গার’-এর রেসিপিসহ একটি রান্নার বই বিক্রি করার কথা বলা হয়।
ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু এফ স্মিথ ২০০৮ সালে লেখেন ‘হ্যামবার্গার: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’ নামের বই। তিনি ১৮৯০–এর দশকের বার্গারের গল্পগুলোকে ‘হ্যামবার্গার ফোকলোর’ বলেছেন। এই লেখার শুরুতে আমরা যাকে গুজব বলেছি। গুজব না বলে এগুলোকে গালগল্পও বলা যায়। আধুনিক বার্গার অনেক রকম স্বাদের। এই বার্গারের গল্পগুলোও কম উপাদেও নয়।