এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : চরফ্যাশন ভোলার মনপুরার ঢালচরের শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা মনপুরার ঢালচরের কয়েক হাজার শিশু শিক্ষাবঞ্চিত। সেখানে কোনো স্কুল নেই। মক্তবে অ-আ-ক-খ শেখার সুযোগ পর্যন্ত নেই। দ্বীপের ছেলেমেয়েদের অনেকেই জানে না স্কুলে কী হয়। শিশুদের বয়স ৬-৭ বছর পেরোতেই কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। ছোটবেলা থেকেই কর্মজীবন শুরু হয়। নিজের অজান্তেই জীবন থেকে শিক্ষার অংশটা ঝরে যায়।
ঢালচরে সরেজমিন ঘুরে অসংখ্য কর্মজীবী শিশুর দেখা মেলে। ওদের জীবনে অবসর বলতে কিছু নেই। পানি টানা, মাঠে গরু-মহিষ চড়ানো, নৌকায় মাছ ধরা, ফসলের মাঠে শ্রম দেয়াসহ ওদের হাতে অনেক কাজ। চারদিকে নদীবেষ্টিত ঢালচরের শিশুদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ আজও গড়ে ওঠেনি। হাইস্কুল তো দূরের কথা, প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত নেই। ফলে চরের ৬ শতাধিক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
১৩ বছরের কিশোর হাছান বড় হয়ে র্যাবে চাকরি করতে চায়। সে জলদস্যুদের হাত থেকে চরবাসীকে রক্ষা করতে চায়। ১২ বছরের বাবু স্বপ্ন দেখে পুলিশের বড় অফিসার হওয়ার। ১৩ বছরের কিশোরী সুরমা বেগমের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে চরবাসীর সেবা করার।
কিন্তু এসব স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে শিশুদের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। ওদের কেউ নদীতে মাছ ধরছে, কেউ মহিষ-গরুর রাখালের কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে সুরমা, আয়শার মতো মেয়েরা বাড়িতে মায়ের কাজে সাহায্য করছে। কখনো বাইরের কাজেও যেতে হচ্ছে।
চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ঢালচর ১৯৫৬ সালে সরকারের কাছ থেকে গ্রহণ করলেও মূলত ২০০০ সাল থেকে বসবাস শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে নদীভাঙনের শিকার আশ্রয়হীন মানুষ এ চরে বসতি গড়ে। সেখানকার মানুষ চরের খাসজমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে চরবাসীর অন্যান্য সংকটের পাশাপাশি শিক্ষা সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চরে তিন হাজার মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ছয় শতাধিক শিশুও রয়েছে। কিন্তু শিশুদের শিক্ষার জন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এর ফলে হাছান, বাবু, সুরমা, মনি, খাদিজা, পলি, সজিব, ইমাম, রাকিবদের মতো সহস্র্রাধিক শিশুর স্বপ্ন অঙ্কুরেই মারা যাচ্ছে।
চরের বাসিন্দা আবদুল বারেকের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ চলে। সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন থাকলেও পূরণ হয়নি। বড় ছেলেকে সফিককে পার্শ্ববর্তী কলাতলী চরের একটি প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শিখিয়েছেন। যোগাযোগ সমস্যা ও দরিদ্রতা বারেকের সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ছেলেমেয়েরা তাকে সাহায্য করে। চরের বাসিন্দা রোকসানা বেগম জানান, তিনি একটি ছেলেমেয়েকেও পড়ালেখা করাতে পারেননি। পাশের চর কলাতলীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে গিয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়। এ কারণে ছেলেমেয়েদের কাজে নেমে পড়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
ঢালচরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। পেশা মাছ ধরা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি জানালেন, এলাকায় স্কুল-কলেজ নেই। ছেলেরা নদীতে মাছ ধরে আর মেয়েরা ঘরে কাজ করে। ছেলেদের অনেকে মহিষের বাথানে কাজ করে। স্কুল থাকলে ওরা পড়ালেখা করতে পারত। কাজে যেতে হতো না।
ঢালচর মসজিদের ইমাম আবুল কালাম জানান, চরে ৫ থেকে ৬ শতাধিক শিশু রয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার অভাবে তাদের লেখাপড়া হচ্ছে না। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলেও চরে স্কুলের সুবিধা গড়ে ওঠেনি। মনপুরার সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী জানান, চরের শিশুদের শিক্ষার কথা বিবেচনা করে তিনি স্কুলের জন্য জায়গা দিয়েছেন, একটি ঘরও নির্মাণ করা হয়েছিল।
কিন্তু এখন আর নেই। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তিনি চরের শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সায়েদুজ্জামান জানান, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ১৫শ' প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হবে। এরই অংশ হিসেবে যে গ্রামগুলোয় লোকবসতি বেশি কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই; সেখানে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/