এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : রাতে মানুষের জ্বালানো কৃত্রিম কোনো আলো ঘিরে পোকা উড়তে থাকে। গত সপ্তাহে এ রহস্য ভেদ করেন বিজ্ঞানীরা। লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র।
আলো বা আগুনকে বন্যপ্রাণীরা ভয় পায়। তবে অদ্ভুতভাবে কিছু পোকা আছে আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। আলোর প্রতি আকর্ষণ এত তীব্র যে, মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তারপরও আলোর দিকে তাদের ছুটে চলা বন্ধ হয় না। এর কারণ কী তা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। তবে সঠিক কোনো যুক্তি বা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেননি তারা। সম্প্রতি নেচার ডটকম জানাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা এই রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন।
যদিও এ গবেষণা কাজ নিয়ে গত বছরই বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ পায়। তবে সম্প্রতি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে নেচার কমিউনিকেশনে। যাতে বিশদভাবে আলোর এ প্রবণতা সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাতের আলোর সঙ্গে অভিযোজনের প্রয়োজনে পোকা সেদিকে ছুটে যায়। একে আকর্ষণ বলে মনে করা হলেও আসলে তা নয়। বরং রাতের আলোর সঙ্গে মানিয়ে নিজের চলার পথ ঠিক করতে পোকারা তার দিকে যায়। কারণ চলাচলের জন্য পোকাদের অন্যতম সহযোগী হলো আলো।
দিনের বেলা আকাশ থেকে আসা আলোর মাধ্যমে তারা চলাচল করতে পারে। আর রাতে নক্ষত্র বা চাঁদের আলোকে কাজে লাগায়। তাদের সেই পরিবেশে যখন কৃত্রিম আলো চলে আসে, তখন তারা বিভ্রান্ত হয়। বুঝে উঠতে পারে না কী করবে।
পুরনো গবেষণা
সায়েন্টিফিক আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা পোকাদের এ আচরণ ব্যাখ্যার চেষ্টা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাই জুতসই মনে হয়নি। নেচার কমিউনিকেশনস এ সপ্তাহে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার ফলে অবশেষে এ রহস্যের সমাধান পাওয়া গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের মতে, কৃত্রিম আলো কীটপতঙ্গকে বিভ্রান্ত করে, তাদের অনুভূতিকে ঝাঁকুনি দেয়।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের কীটতত্ত্ববিদ স্যামুয়েল ফ্যাবিয়ান বলেন, আমরা পোকামাকড়ের এ আচরণের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছি, যা এখন পর্যন্ত একটি ধাঁধা হয়েছিল।
অনেক ব্যাকটেরিয়ার শরীরে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। এসব ব্যাকটেরিয়া আলোর দিকে এগিয়ে যায়। সালোকসংশ্লেষণ তাদের খাদ্যের জোগান দেয়। তাদের জন্য বিষয়টা যৌক্তিক। কিন্তু মথ বা ড্রাগন ফ্লাইয়ের দেহে তো সালোকসংশ্লেষণ ঘটে না। তারপরও তারা কেন আলোর দিকে উড়ে যায়? বিজ্ঞানীরা নানাভাবে এর ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেয়েছেন, তবে খুব একটা সফল হননি।
কেন আলোর প্রতি পোকামাকড়ের এ আকর্ষণ, যা তাদের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে অনেক অনুমান উত্থাপন করেছেন। একজন বলেছিলেন, যে নিশাচর পোকামাকড়ের এটা এক ধরনের প্রবৃত্তি। তারা নিজেদের দৃষ্টিসীমার ভেতর সবচেয়ে উজ্জ্বল স্থানের দিকে উড়ে যায়। তারা হয়তো ভাবে যে, ওই আলো আকাশ থেকে আসছে। অন্য একজন পরামর্শ দেন, পোকামাকড় আলো থেকে নির্গত তাপ দিয়ে নিজেদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা চালায়। আবার কেউ কেউ দাবি করে যে, কৃত্রিম আলোর ঝলক দেখে পোকামাকড় অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এভাবে আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার কারণ নিয়েও অনেক গবেষক কথা বলেছেন। নেদারল্যান্ডসে ডাচ বাটারফ্লাই কনজারভেশনের প্রধান রয় ভ্যান গ্রুনসভেন বলেন, কেন মরে যেতে ইচ্ছে হয় পোকাদের, তা এক বিস্ময়। কৃত্রিম আলোর ওপর পড়ে পোকারা মারা যায়। এক অর্থে পোকাদের এই আত্মহত্যা বিচিত্র। তবে এটি আত্মহত্যা কি না তা নিশ্চিত বলা যায় না। কারণ চার্লস রবার্ট ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী সবাই বংশবৃদ্ধি করতে চায়। পোকাদেরও তাই চাওয়ার কথা। মানুষ রাগ-অভিমান থেকে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা ভাবে। পোকাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভাব আসার সুযোগ নেই। তাই দলে দলে তাদের আত্মাহুতি দেওয়া।
গবেষক যশ সোধি বলেন, সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব ছিল, পোকামাকড় চাঁদ বা অন্যান্য মহাকাশের বস্তুর সঙ্গে আলোর উৎসগুলোকে গুলিয়ে ফেলে। এসব উৎসকে কাজে লাগিয়ে তারা দিক নির্ণয় করতে পারত। তবে নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের কোনো প্রবণতার কারণে পোকারা আলোর দিকে আকৃষ্ট হয় না।
চলার পথে আলো
বিজ্ঞান ব্লগ ডটওআরজি থেকে জানা যায়, আলোক উৎসের সঙ্গে কৌণিক দূরত্ব বজায় রেখে পতঙ্গরা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। একে ট্রান্সভার্স ওরিয়েন্টেশন বলে। যার অর্থ, রাতের বেলা পতঙ্গরা চাঁদকে কেন্দ্র করে তাদের ওড়ার পথ নির্ধারণ করে। পোকা বা পতঙ্গরা নির্দিষ্ট একটি পথে যাতায়াতে অভ্যস্ত। আর রাতের বেলা চাঁদের আলো তাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
এখন যদি তাদের চলার পথে কোনো আলো চলে আসে তাহলে তারা এর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। সাধারণ অর্থে একে আকর্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে নতুন গবেষণা বলছে এটি আকর্ষণ নয়। রাতের বেলা কৃত্রিম আলো জ¦ললে আশপাশের পোকারা সে দিকে ছুটে যায়। অনেক দূর থেকে যে পোকারা ছুটে আসে আলোর দিকে তা কিন্তু না। যেখানে আলো জ¦লানো হয়েছে তার আশপাশে চলাচলরত পোকারা সেদিকে ছুটে যায়। যেমন অনেকে চাষাবাদের জমিতে আলোর ফাঁদ তৈরি করে। ওই জমিতে থাকা পোকারা আলোর দিকে উড়ে আসে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। এভাবে ফসলকে পোকার হাত থেকে রক্ষা করে। আলোর দিকে পোকার ছুটে যাওয়ার স্বভাব কাজে লাগিয়ে কৃষকরা এ ফাঁদ তৈরি করে।
পোকারা যে আলোর দিকে ছুটে যায়, এর কারণ তারা মনে করে দিনের বেলার মতো হয়তো আকাশ থেকে আলো আসছে। তারা আলোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে চলাচলের পথ নির্ধারণ করতে চায়। কৃত্রিম আলো তাদের সেই চলার পথে ব্যাঘাত ঘটায়।
কয়েক বছর আগে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব সিঙ্গাপুর’ পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, কৃত্রিম আলোয় থাকা নীল এবং বেগুনি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রধানভাবে পতঙ্গদের আকৃষ্ট করে। হলুদ এবং লাল আলো সবচেয় কম আকৃষ্ট করে। পরাগায়নের জন্য পতঙ্গদের আকৃষ্ট করতে অনেক ফুল থেকে যে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি নির্গত হয় তা প্রধানত নীল এবং বেগুনি বর্ণের আলোর বৈশিষ্ট্যের সমান। যা ফুলের ওপর খাবার সংগ্রহকারী পোকামাকড়দের আকৃষ্ট করে। রাতের বেলার কৃত্রিম আলোতেও এ উপাদান থাকতে পারে। যার ফলে পোকারা আলোর দিকে ছুটে যায়।
পোকার শরীরে ক্যামেরা
প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য, দলটি ইম্পেরিয়াল কলেজে পোকামাকড় আছে, এমন স্থানে প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছে। গবেষকরা তিনটি মথ এবং দুটি ঘাসফড়িং প্রজাতি থেকে ৩০টি পোকামাকড় অনুসরণের জন্য মোশন-ক্যাপচার প্রযুক্তিতে সজ্জিত আটটি উচ্চগতির ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তারা আরও ছয় ধরনের পোকামাকড়কে এ গবেষণায় যুক্ত করেন। যেগুলোর মধ্যে ছিল ফলের মাছি এবং মৌমাছি। এসব পোকা মোশন-ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য খুব ছোট। তবে তাদেরও আলোর প্রতি আকর্ষণ কতটা, তা খতিয়ে দেখা হয়।
গবেষকরা কোস্টারিকার জঙ্গলেও এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তারা বন্য পোকামাকড়ের আচরণগত পাঠ করার জন্য দুটি স্থানে ভারী ক্যামেরা, আলো এবং ট্রাইপড স্থাপন করেন।
গবেষক দলের সদস্য ফ্যাবিয়ান বলে, আমরা বেশ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। কিন্তু যদি শুধু ভিডিওগুলো দেখি, তাহলে দেখব যে, কীটপতঙ্গগুলো ক্রমাগত আলোর দিকে উল্টো হয়ে তাদের পিঠ নাচাচ্ছে।
দলটি যাচাই করতে সক্ষম হয়েছিল যে, পোকামাকড়গুলো আকৃষ্ট হয়ে নয় বরং তারা আলোকে প্রদক্ষিণ করে এর পেছন দিক দিয়ে এবং কাত হয়ে। এ আচরণ ‘ডোরসাল লাইট রেসপন্স’ হিসেবে পরিচিত। সাধারণত এ আচরণ পোকামাকড়কে উড়ানের জন্য একটি অপরিবর্তনীয় পথে থাকতে সাহায্য করে, যার ফলে দিগন্ত তাদের সামনে উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু কোনো উৎস থেকে আসা কৃত্রিম আলো তাদের ওড়াউড়ির পথে বিভ্রান্তি নিয়ে আসে। তারা ওই আলোকে মনে করে আকাশ। যে কারণে তারা আলোর দিকে পেছন ফিরে ওড়ার চেষ্টা করে।
গবেষকরা দেখেছেন যে, গবেষণাগার এবং মাঠে পোকামাকড় স্বাভাবিকভাবে ওড়ে যখন আলো ছড়ানো থাকে এবং তাদের মাথার ওপর থেকে নেমে আসে। কিন্তু যদি একটি বিন্দু থেকে আলো আসে তখন তারা বিভ্রান্ত হয়। তারা বলছেন, আলোর দিকে ছুটে যাওয়ার কারণ আকর্ষণ নয় বরং অভিযোজন।
জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ ফ্লোরিয়ান অল্টারম্যাট বলেন, যখন আমি এই গবেষণাটি পড়ি তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। কারণ এটি প্রথমবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী ঘটনার সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কীটতত্ত্ববিদ অ্যাভালন ওয়েনস বলেন, এটি একটি নতুন পর্যবেক্ষণ, যা উত্তেজনাপূর্ণ। এমন একটি ঘটনা যা মানুষ সম্ভবত সহস্রাব্দ ধরে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভাবছে। কিন্তু উত্তর পাচ্ছিল না। হাই-স্পিড ক্যামেরা প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে বিজ্ঞানীরা স্পষ্টতই অপ্রত্যাশিত কিছু আবিষ্কার করেছেন।