এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : বুড়িগঙ্গা নদীতে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসছে সাকার মাছ। একে নানাজনে নানা নামে ডাকে। বুড়িগঙ্গার মাঝিরা একে বলে রোহিঙ্গা মাছ। বিকট দর্শন হওয়ায় অনেকে একে ডাকে রাক্ষুসে মাছ নামে। কেউবা ডাকে ডেভিল ফিস বা শয়তান মাছ নামে।
কেননা এ মাছ নদীতে থাকা অন্য মাছের ডিম ও মাছকে খেয়ে ফেলে। এছাড়াও নদীতে থাকা ময়লা আবর্জনাসহ সকল কিছুও খেয়ে ফেলে। ১৯৮০ সালে অ্যাকুরিয়ামে ব্যবহারের জন্য আনা হয় এই মাছ। তারপর কোনোভাবে এই মাছ ছড়িয়ে যায় নদী বা জলাশয়ে।
সাকার মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিপোস টমাস গ্লোকাস টমাস।‘ অবাক করার বিষয় হলো এর টিকে থাকার ক্ষমতা। পানি ছাড়াও এ মাছ ২৪ ঘণ্টার বেশি বাঁচতে পারে। গবেষকদের মতে, ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম দেখা মিলে এই মাছের। পরে ব্রাজিল, পানামা, মেক্সিকোতে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে।
তবে মেক্সিকো থেকে সাকার মাছ ধরে তা যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হচ্ছে। এটা প্রক্রিয়াজাত করে সেখানে বিক্রি করা হচ্ছে। সাকার মাছের শুটকি কুকুর-বিড়ালের খাবার হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়াও মেক্সিকোতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টেও সাকার মাছ ঢুকে পড়েছে। মাছের নির্দিষ্ট একটি অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বার্গার, ফিস চিপস। এটি সেখানে ভালো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হলে তা দেখে বাংলাদেশও সাকার মাছ খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। অনেকেই শখ করে খাচ্ছে এই মাছ। আবার অনেকে ফুড ভ্লগিংয়ের মাধ্যমে সাকার মাছ রান্নার রেসিপি তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে ‘এম ইন বিডি’, ‘মুসাফির’, ‘শিউলি কিচেন’, ‘সাম্পী হালদার’ ইত্যাদি চ্যানেলে সাকার মাছ রান্নার রেসিপি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশে এখনো একে ভালোভাবে নেয়া হয়নি। এর ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে সাকার মাছের উৎপাদন, প্রজনন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা এই মাছে ভারী ধাতুসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে। তাছাড়া দেশী প্রজাতির মাছ এবং জলজ প্রাণীর জন্যও হুমকি এই মাছ। আমাদের উন্মক্ত জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রও ধ্বংস করে দিতে পারে বলে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
তবে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সাকার মাছ নিয়ে গবেষণা করে এই মাছের পুষ্টিগুণ তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, সাকার মাছের প্রায় ২৫ শতাংশ আমিষ, ৩.৭৮ শতাংশ চর্বি ও প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও মিনারেলস রয়েছে। এছাড়াও সাকারের শুটকিতে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আমিষ পাওয়া যায়। এ মাছ খাওয়ার উপযোগী হিসেবে তারা তুলে ধরেছেন।
এটাকে কাজে লাগালে কালো সোনা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে এই মাছ। বিপুল পরিমাণে পাওয়া যাওয়ায় একে সফলভাবে ব্যবহার করা গেলে অনেকের ভাগ্য ফিরতে পারে এই মাছের মাধ্যমে।
বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরা জেলে ভুবন মাঝি জানান, ‘আগে আমরা শিং, কই, টাকি, ইচা মাছ ধরতাম। এখন এই মাছের যন্ত্রণায় অন্য কোনো মাছ নাই। জাল ফেললে এই মাছ ছাড়া অন্য মাছ ওঠে না।’
তার কাছে এই মাছ খাওয়া যায় কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমি এই মাছ কখনো খাই নাই। অনেকে আমার কাছ থেকে এই মাছ নিয়ে যায়। অনেকে শখ করে এই মাছ খায় আবার অনেকে ওষুধ মনে করে খায়।’
এই মাছ বিক্রি করা যায় কিনা প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ‘এখনো ওইভাবে কেউ কিনে না। তবে ধইরা দিলে খুশি হইয়া ১০০ বা ২০০ টাকা দিয়া যায়।’ পাশেই সদরঘাট এলাকায় থাকা সাব্বির জানান, ‘আমি এই মাছ খাইছি। কাল্লা ফালায় দিয়া আর চামড়া ছুইল্লা ভিতরের অংশ খাইতে হয়। খাইতে ভালোই লাগে।’
বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায় ব্যবসা করা রহিমাতুল্লাহ জানান, ‘সাকার মাছ খুব দ্রুত বংশ-বিস্তার করতে পারে। নদীর কিনারায় দাঁড়ালেই এই মাছের দেখা পাওয়া যায়। এই মাছ যেহেতু খাওয়া যায় এবং এতে ভালো পুষ্টিগুণও রয়েছে, তাই এটি যদি বিক্রির ব্যবস্থা করা যায় তবে স্থানীয় অর্থনীতিতে বেশ ভালো প্রভাব রাখবে। আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাতে এ মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করা যেতে পারে।’
পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা পাড়ের বাসিন্দা আফতাব খান জানান, ‘সাকার মাছে পুরা নদী ভরে গেছে। তবে, এ মাছকে ঘিরে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ মাছকে ঘিরে তৈরি হতে পারে নতুন এক অধ্যায়ের।
নদ-নদীগুলোতে যে হারে সাকার মাছ বাড়ছে, ভবিষ্যতে হয়তো আর অন্য কোনো মাছ পাওয়া যাবে না। তাই এই বিপুল পরিমাণ মাছকে খাওয়ার উপযোগী করা গেলে তা আমাদের জন্য ভালোই হবে।’