এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : আম। কী নাম শুনেই খেতে মন চাইছে তাইতো? গ্রীষ্ম, বর্ষা, কিংবা শীত সব মৌসুমেই ছোট-বড় সবার প্রিয় এই সুস্বাদু রসালো আম। যে মৌসুমেই হোক; এক গ্লাস তরতাজা আমের জুস পেলে মন্দ হয় না- কী বলুন?
তবে এই অসময়ে কোথায় মিলবে আম? হ্যাঁ মিলবে। এখন সারা বছরই মিলবে রাজশাহীর আম। সারা বছরই নেওয়া যাবে মিষ্টি মধুর রসালো এই ফলের স্বাদ।
কৃষি প্রধান এই দেশের চাষ পদ্ধতি এতদিন থেকে চলছে সেই আগের সনাতনী নিয়মেই। তবে দেরিতে হলেও দেশের কৃষিতে লাগতে শুরু করেছে পরিবর্তনের হাওয়া। কৃষি নির্ভরশীল এই দেশে ধরাবাঁধা নিয়মের পরম্পরা ভাঙতে শুরু করেছে- আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান। চাষবাষ নিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তাশীলতা বিকশিত হচ্ছে।
আধুনিক এই যুগে কৃষি ব্যবস্থা নিয়েও শুরু হয়েছে গভীর অন্বেষণ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তাই আবারও আশাজাগানিয়া হয়ে উঠছে বাংলাদেশের কৃষি। মিশ্র চাষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক জমিতে ফলছে হরেক রকম ফল ও ফসল। অসময়ের ফসল ফলছে সারা বছরই। তাই নতুন নতুন সব চাষ পদ্ধতি কৃষকদের দেখাচ্ছে- নতুন দিনের স্বপ্ন। আর এ যেন স্বপ্ন নয়, সফল কৃষি গাঁথা।
এর আগে আমের ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি কী এবং তার সফলতা ভোগ করছে দেশীয় কৃষি ব্যবস্থা। সবাই দেখেছেন কীভাবে বালাইনাশক ছাড়াই সব ধরনের পোকামাকড় থেকেই পুরোপুরি নিরাপদ রাখা যায় স্বাদের আম। এবার দেখছেন কীভাবে সারা বছর চাষ করা যায় বিশেষ এক- জাতের আম।
বর্তমান কৃষি বিজ্ঞান এমন এক জাতের আমের সঙ্গে কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে- যেই আম চাষ করা যায় বারোমাসই। এতে উৎপাদন ও লাভ দুটোই বেশি। তাই অনেকেই এখন নতুন এই জাতের আম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
আর রাজশাহীর আম বলে কথা, সুখ্যাতি যার বিশ্বজুড়েই। এই আমের কারণেই রাজশাহীর নাম ছড়িয়ে আছে দেশ থেকে সারা বিশ্বে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত ফজলি, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাত, লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও আশ্বিনাসহ নানা প্রজাতির আম বরাবরই প্রসিদ্ধ। গেল মৌসুমেও এখানকার ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে রাজশাহীতে আমচাষ বেশি লাভজনক হওয়ায় চাষিরা এখন প্রতি বছরই উন্নত জাতের বাগান করছেন।
তবে গত দুই বছর থেকে নতুন জাতের এক বারোমাসি আম চাষ করা হচ্ছে রাজশাহীতে। আমটির নাম কাটিমন। কৃষি বিভাগ বলছে- একদম নতুন জাতের আম হওয়ায় বর্তমানে রাজশাহীর ৯ হেক্টর জমিতে কাটিমন আমের চাষ হচ্ছে।
রাজশাহীর দুর্গাপুর, পুঠিয়া, চারঘাট, বাঘা উপজেলার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমের মৌসুমে সব জাতের আম বাজারে আসে। তবে কাটিমন জাতের আম মৌসুম ছাড়াও বাকি সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ গাছে ধরে। এতে চাষিদের লাভের অংক বেড়ে দাঁড়ায় কয়েকগুণ।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, গত দুই বছর থেকে রাজশাহী জেলার কয়েকটি উপজেলার প্রায় নয় হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কাটিমন জাতের বারোমাসি আম চাষ করা হচ্ছে। আমের বাগানগুলোতে নিয়মিত পরিচর্যা করায় আশানুরূপ আমের ফলন পাওয়া যাচ্ছে। মৌসুমের পরও গাছে আম ধরায় অসময়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে কাটিমন। এতে চলতি বছর স্থানীয় চাষিদের আগ্রহ আরও বেড়েছে। চাষিরা এখন বাণিজ্যিকভাবে কাটিমন আমের বাগান করতে জমি নির্বাচন কাজ শুরু করেছেন।
কাটিমন আম তাই এখন কৃষকের সফলতারই ফসল। কাটিমন আমটি দেখতে সাধারণত লম্বাটে আকারের। এটি পাকলে আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণের রং ধারণ করে। কাটিমন আমের বিশ্বজোড়া খ্যাতি এখন কেবল তার মিষ্টতার জন্যই। দারুণ মিষ্টি।
আর আমে আঁশ নেই বললেই চলে। বারোমাসি এই আম কাঁচা খেতে যেমন মিষ্টি তেমন পাঁকলেও। আমের আঁটি তুলনামূলক ছোট। প্রতিটি আমের গড় ওজন ৩০০-৩৫০ গ্রাম। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সের এক একটা গাছে দেড় মণেরও বেশি আম ধরে।
এটি থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। একই গাছে এক সঙ্গে মুকুল, গুটি ও পাকা আম থাকে। অনেক সময় বেশি পর্যায়ের মুকুল বা আমও থাকে। নাবি জাতের এই আম চাষে চমক দেখিয়েছেন- রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম। শীতের হাতছানি দেওয়া এই কার্তিকেও তার বাগানে ঝুলছে গাছ ভর্তি কাটিমন আম। আর নিচে পুকুরে চাষ হচ্ছে রূপালি মাছ ও পুকুরপাড়ে হচ্ছে রঙিন আম।
নির্ধারিত মৌসুম শেষ হওয়ায় কাটিমন আমের বাজার মূল্য এখন বেশ চড়া। আর শুধু একবার নয় তিনি এই আমের ফলন পাচ্ছেন বছরে অন্তত তিনবার। বর্তমানে যার বাজারমূল্য মণ প্রতি আট থেকে ১০ হাজার টাকারও বেশি।
এ উদ্যোক্তার মতে জ্যৈষ্ঠ মাসে জাতের আম উৎপাদনের চেয়ে এই কাটিমন আমেই লাভ বেশি। গাছে ফলন আসতে সময় নেয় কম। তবে পরিচর্যাও করতে হয় অন্য গাছের তুলনায় বেশি। তাই কার্তিকেও যেন আমের ভরা মৌসুম এখানে। তার মাছ চাষের জন্য তৈরি পুকুরপাড়ে লাগানো হয়েছে সারি সারি কাটিমন আম গাছ। তিন বছর আগে লাগানো হয়েছিল এই গাছ। আর গাছ লাগানোর মাত্র কয়েকমাস পরই ফলন দিতে শুরু করেছে।
রফিকুল ইসলাম তার দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের পুকুরপাড়ে ছোট ছোট কাটিমন আম গাছের বাগান গড়ে তুলেছেন। চলতি মৌসুমে গাছ রোপণের তিন বছর পূর্ণ হবে। তবে তাতে কি! ফলনের কমতি নেই গাছগুলোতে, একই সঙ্গে রয়েছে আম, গুটি ও মুকুল। মৌসুম শেষ হওয়ায় এই আমের চাহিদা আকাশচুম্বী। বাগান থেকেই আট হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে এ আম।
রফিকুল ইসলাম জানান, মূলত নির্ধারিত মৌসুমের বাইরে আমের স্বাদ দিতেই তার এ বাণিজ্যিক উদ্যোগ। দিনাজপুর থেকে আড়াই হাজার আম গাছ কিনে তিনি এ বাগানের শুরু করেছিলেন। তখন প্রতি গাছের দাম পড়েছিল ১৭৫ টাকা করে। গত বছর প্রথমবার ৩০ মণ আম বাজার জাত করে আড়াই লাখ টাকা আয় করেন তিনি। এ বছর ফলন ও দাম দ্বিগুণ আশা করছেন।
নিয়মিত সেচ দেওয়া, পোকা থেকে বাঁচাতে স্প্রে ব্যবহার করতে হয়। তবে আম পরিপক্ব হতে কোনো স্প্রে করতে হয় না। অধিক ফলন হয় বলে এ গাছে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ রয়েছে।
রফিকুল ইসলামের মতে, আগামী বছর আম বিক্রি করলেই তার লগ্নি করা মূল পুঁজি উঠে আসবে। তারপর থেকেই লভ্যাংশ আসা শুরু হবে। তবে বছরে তিনবার ফলন দেয় বলে এ গাছ পরিচর্যায় শ্রমিক বেশি প্রয়োজন। মূলত কম জায়গায় ঘন করে সহজেই বছরে একাধিকবার উৎপাদন করা যায় সুমিষ্ট কাটিমন আম। রাজশাহীতে বিভিন্ন জাতের আম উৎপাদনের বড় বড় বাগান থাকলেও কাটিমন জাতের আম বাগানের সংখ্যা খুব কম।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, এটা নতুনভাবে থাইল্যান্ড থেকে আনা একটি বারোমাসি আমের জাত। দুই বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে এই আম চাষ হচ্ছে। তাদের ফল গবেষণা কেন্দ্রে এই জাতের আমের বেশ কয়েকটি গাছ রয়েছে। মৌসুম শেষেও অমৌসুমে বেশ কিছু আম পাওয়া যাচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, বারোমাসি জাত হওয়ায় বেশি দামে কৃষকরা আম বিক্রি করতে পারছেন। তাদের কাছে জাতটি বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। তারা চেষ্টা করছেন কীভাবে এই কাটিমন আমকে আরেকটু উন্নত করা যায়। এটিকে আরও বেশি ফলবান করা যায়।
এর প্রডাকশন টেকনোলজি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি এ আমের ক্যারেক্টারকে নিয়ে তারা বারি আম-১১ এর সঙ্গে ক্রসিংয়ের মাধ্যমে আরও ভালো জাত উদ্ভাবন করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি আরও জানান, এখন গাছগুলো ছোট আছে। গাছ আরও বড় হলে এর ফলাফল সম্পর্কে আরও ভালো এবং স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে।