ড. মুহাম্মাদ তালুত : গরমকালে এসি বিস্ফোরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এতে ছড়ায় অগ্নিকাণ্ড, মৃত্যু হয় মানুষের। কিন্তু এসি বিস্ফোরণের কারণ কী? চলুন বিষয়টি অনুসন্ধান করি।
প্রথমেই ভাবা যাক কুল্যান্ট বা হিমায়কের ব্যবহার নিয়ে। রেফ্রিজারেশন সাইকেলের বিষয়টি এখন অষ্টম-নবম শ্রেণির বইতেই আছে। শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্য না, জীবন বাঁচাতেও এই জ্ঞান জরুরি।
কম্প্রেসর, কন্ডেন্সার, এক্সপানশন ভাল্ভ আর ইভাপোরেটর হল বহুল ব্যবহৃত এসির চারটা প্রধান কম্পোনেন্ট। একটা ক্লোজড কপার টিউবের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করা হয় হিমায়ক বা কুল্যান্ট ফ্লুয়িড যা ঐ টিউবের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কম্পোনেন্টগুলোর ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তাপ গ্রহণ করে বা পরিত্যাগ করে বিভিন্ন সময়ে তরল বা বাষ্পীয় বা মিশ্র দশায় উপনীত হয়।
মূলনীতি খুব সহজে বলতে গেলে, ইভাপোরেটরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় তরল হিমায়ক রুমের বাতাস থেকে তাপ শোষণ করে রুমকে ঠাণ্ডা করে ফেলে। আর হিমায়ক নিজে তাপ নিয়ে গরম হয়ে বাষ্প হয়ে গিয়ে ঢোকে কম্প্রেসরে। সেখানে চাপ প্রয়োগ করে এর আয়তন কমিয়ে ফেলা হয়। এরপর তা চলে যায় কন্ডেন্সারে। সেখান থেকে এই হিমায়ক পরিবেশে তাপ ছেড়ে দেয় আর নিজে তরল হয়ে যায়, ঠিক যেভাবে জলীয়বাষ্প তাপ পরিত্যাগ করে ঘনীভূত হয়ে তরল বৃষ্টিতে পরিণত হয়।
এই ঠাণ্ডা তরলীকৃত হিমায়ক আবার রুমের ভেতরে এক্সপানশন ভাল্ভ পেরিয়ে প্রসারিত ও ঠাণ্ডা হয়ে (হঠাৎ প্রসারিত করা হলে গ্যাস ঠাণ্ডা হয়ে যায়) ইভাপোরেটরে চলে যায়, চক্রটি আবার পুনরায় শুরু হয়।
আসলে এসির আউটডোর ইউনিট থেকে বাইরে যে গরম হাওয়া বেরিয়ে আসে তা হল রুমের ভেতর থেকে অপসারিত তাপ, এটি নতুন করে উৎপাদিত কোন তাপ শক্তি নয় যা বায়ুমণ্ডলকে গরম করছে। তবে এটিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের উৎস যদি গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন করে তাহলে সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে দায়ী।
আমাদের দেশের বাসায় ব্যবহৃত ফ্রিজ/রেফ্রিজারেটরে ব্যবহার করা হয় সাধারণত দুইরকমের ফ্রেয়ন বা হিমায়ক। সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বন আর এইচএফসি বা হাইড্রোফ্লুরোকার্বন। ফ্রিজে প্রথমটার ইউজ বেশি। আর এসিতে পরেরটা। তবে সিএফসির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ওজন স্তরে ফাটল ধরছে আবার বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই এইচএফসি ব্যবহারের প্রসার বাড়াচ্ছে সবাই।
অনেক হিমায়ক বা কুল্যান্ট দাহ্যও বটে, তবে আগুন ধরতে হলে প্রথমে স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গ দরকার, এছাড়া তারা নিজে থেকে জ্বলে উঠতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল এই স্পার্ক আসে কোথা থেকে?
দেশের বেশিরভাগ বাসাবাড়ির রুমে দেখবেন, এসি ব্যবহার করা হলেও সেগুলো এয়ার টাইট না; যার ফলে প্রচুর লিকেজ হয়। ফলে ঠাণ্ডা বাতাস বেরিয়ে যায়, এসিতে ইনপুট দেওয়া কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রায় পৌঁছুতেই পারে না রুমটি। এসি ক্রমাগত চলতেই থাকে। কিন্তু এসি আসলে বিরামহীন চলার জন্য তৈরি না। এর কম্প্রেসর একটি রোটেটিং মেকানিক্যাল যন্ত্র। এর ভেতর একটি পাখা/রটোর প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকে, যার দুই প্রান্তে আছে বিয়ারিং। বিয়ারিং ঘর্ষণে উত্তপ্ত হতে থাকে, তাই এসির সাথে লাগানো থারমোসেন্সর ঘরের তাপমাত্রা কাঙ্খিত ঠাণ্ডায় পৌঁছুলেই এটি বন্ধ করে দেয়, বিশ্রাম পায় কম্প্রেসর, কিছুটা ঠাণ্ডাও হয়।
কিন্তু ঘরে লিকেজ থাকায় এসিটি অনবরত চলতেই থাকে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আর ঠাণ্ডা করতে পারে না। বিয়ারিংয়ের অনবরত ঘূর্ণনে উত্তপ্ত হয়ে বিয়ারিং গলে যায় বা ফেইল করে, ধাতব তলে ঘষা খেয়ে জ্বলে উঠে স্ফুলিঙ্গ। একই ঘটনা গাড়ির ইঞ্জিনে কুলিং সিস্টেম ফেল করলেও হতে পারে, ইঞ্জিন ব্লকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত পিস্টন গলে আটকে গিয়ে ইঞ্জিন বসে যায়। যাই হোক, ঐ স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয় দাহ্য ফ্রেয়ন বা কুল্যান্ট, বিস্ফোরিত হয় গোটা এসি, ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
এসি’র দুর্ঘটনা ঠেকাতে হলে আমাদের রুমের লিকেজ লস কমাতে হবে। দরজায় ডোর ক্লোজার বডি ও সিল ব্যবহার করতে হবে, জানালায় ভারী পর্দা দিতে হবে যেন সূর্যের আল বেশি না ঢুকে। সেই সাথে দরকার ভালো ব্র্যান্ডের এসি ব্যবহার করা, যেটিতে ভালো মানের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়। একটি ভালো এসির বিয়ারিং চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এসব বিয়ারিং সহজে ফেইল করে না, অনবরত চলতে পারে দীর্ঘ সময় ধরে। সস্তা এসিতে সস্তা বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়। অনবরত ব্যবহারে দ্রুত এগুলো ফেইল করে। তাই ভালো ব্র্যান্ডের এসি ব্যবহারের বিকল্প নেই।
হাতে টাকা কম থাকলে দরকার হলে টাকা জমিয়ে কিছুদিন পর কিনুন। কিন্তু সস্তা এসি কিনে নিজের জীবনে ঝুঁকি ডেকে আনবেন না। ভালো ব্র্যান্ডের এসির কপার ডাক্ট/টিউবিংও ভালো হয় যা অত সহজে করোশনে লিকও হয় না, পুরো সিস্টেমটিও ভালোভাবে চলে। এছাড়া, এসি নিয়মিৎ সার্ভিসিং করাতে হবে। আউটডোর ইউনিট এবং ইনডোর ইউনিট পরিষ্কার রাখতে হবে।
তাপমাত্রা ইদানীং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরের তাপমাত্রা এত বেশি হলে যে ফ্রেয়ন আমরা সচারাচর ব্যবহার করি, তা আর তাপ ছেড়ে প্রয়োজনীয় আয়তনের তরলে পরিণত হতে পারছে না। ফলে এটির ঠাণ্ডা করার বা তাপ শোষণ করার ক্যাপাসিটি কমে যাচ্ছে, রুমও ঠাণ্ডা হচ্ছে না, ফলে চলতেই থাকছে এসি, এসময় গরম হয়ে ঘটাচ্ছে বিস্ফোরণ। এক্ষেত্রে আমাদের কুল্যান্ট/ফ্রেয়নের ধরন পাল্টাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের এসিগুলোতে যে কুল্যান্ট ব্যবহার করা হয় তা বাইরে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকলেও ঘর ঠাণ্ডা করতে পারে। ঐসব কুল্যান্টের থার্মোডাইনামিক প্রোপার্টিটাই এমন। আমাদের দেশেও ঐ ধরনের কুল্যান্ট ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।
এসির দুর্ঘটনায় বিদ্যুতের লাইন আরেকটা ফ্যাক্টর। কম বা অতিরিক্ত ক্যাপাসিটির লাইন/তার ব্যবহার করলে লোড নিতে না পেরে না বা বেশি কারেন্ট সাপ্লাইয়ের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারে যন্ত্রটি। নিজে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, বা কোথাও শর্ট সার্কিট হয়ে ঘটাতে পারে দুর্ঘটনা। এটিও এড়ানো দরকার। দক্ষ ও অভিজ্ঞ মেকানিক ডেকে এসি লাগান। লাইনের ক্যাপাসিটি অপর্যাপ্ত হলে দরকার হলে নতুন করে লাইন করুন। সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সরকারের উপসচিব; যন্ত্রকৌশলী ও জ্বালানী নীতি বিষয়ক পরামর্শক