এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : দীর্ঘদিন হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন রাজ্জাক সাহেব। বিশেষ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে কিংবা টয়লেটের প্যানে বসতে গেলে এই ব্যথা পরিণত হয় যন্ত্রণায়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এক বা একাধিক সদস্য হাঁটু ব্যথায় ভুগছেন।
আগে মনে করা হতো, এই স্বাস্থ্য সমস্যাটি কেবল বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়ে থাকে। এই ধারণা ভুল। কারণ, স্বাস্থ্য জটিলতার ওপর নির্ভর করে যেকোনো বয়সী মানুষই হাঁটু ব্যথায় ভুগতে পারেন।
এই রোগটির কারণ নিয়ে অনেকে দ্বিধায় থাকেন। কেন হয় হাঁটু ব্যথা? কী কী উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে? কষ্টদায়ক এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী? সব প্রশ্নের জবাব জানুন এই প্রতিবেদনে-
হাঁটু ব্যথার কারণ
বিভিন্ন কারণে হাঁটু ব্যথা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে কিছু ব্যথা ক্ষণস্থায়ী, কিছু দীর্ঘস্থায়ী। মোটাদাগে বলতে গেলে হাঁটু ব্যথার কারণ তিনটি— আঘাতজনিত, ক্ষয়জনিত ও বাতজনিত।
আর্থ্রাইটিসের কারণ হাঁটু ব্যথা
হাঁটু ব্যথার প্রধান কারণ হলো অস্টিও আর্থ্রাইটিস বা অস্থিসন্ধির ক্ষয়। মানবদেহের প্রতিটি সন্ধি বা জয়েন্টের মতোই হাঁটুর জয়েন্টের হাড়ও নরম আর মসৃণ আবরণ বা কার্টিলেজ দ্বারা আবৃত থাকে। কোনো কারণে এই কার্টিলেজ যখন ক্ষয় হয়ে অমসৃণ হয়ে যায় তখন জয়েন্ট নাড়াচাড়ায় ব্যথা অনুভূত হয়, জয়েন্ট ফুলে যায়। একেই অস্টিও আর্থ্রাইটিস বলে। সহজ ভাষায় যাকে হাঁটুর এক প্রকার বাত বলা যায়।
আর্থ্রাইটিসের কারণে হাঁটু ব্যথার ক্ষেত্রে আবার কিছু বিষয় মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
বয়সজনিত ক্ষয়: বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের পর হাড় ক্ষয়ের কারণে হাঁটু ব্যথা দেখা দেয়।
লিঙ্গ: পুরুষের তুলনায় নারীদের আর্থ্রাইটিস বেশি হয়। মনোপোজ বা মাসিক বন্ধের পর এই সমস্যা দেখা দেয়। যাদের হিস্টেরেক্টমি সার্জারি হয়েছে তাদেরও আর্থ্রাইটিস হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন: মানবদেহের অন্যতম ওজন বহনকারী সন্ধি হাঁটু। তাই দেহের অতিরিক্ত ওজন হাঁটুতে অধিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে হাঁটুর ক্ষয়ের মাত্রা বাড়ে।
মাংসপেশির দুর্বলতা: দুর্বল মাংসপেশি হলে তা হাঁটুর সন্ধিকে স্বাভাবিক স্থানে ধরে রাখতে পারে না। এতে ঘর্ষণ বেশি হয়, ক্ষয়ও বেশি হয়।
আঘাতজনিত কারণ বা জয়েন্ট ইঞ্জুরি
আঘাতজনিত কারণে অনেকসময় হাঁটু ব্যথা দেখা দেয়। বিশেষত খেলাধুলার ইনজুরি বা কোনো দুর্ঘটনায় লিগামেন্টের আঘাত লাগলে তা থেকে হাঁটু বা জয়েন্টে ব্যথা হয়ে থাকে। পেশিতে টানের কারণে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। আবার অনেকসময় স্টেরয়েড ইনজেকশনের কারণেও হাঁটুতে ব্যথার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হাড়ে চোট লাগার কারণে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। আগে কখনও দুর্ঘটনার সময় হাড় ভেঙে গেলে পরবর্তীতেও এই ব্যথা থেকে যায়। আর দুর্ঘটনাবশত যদি হাড় ভেঙে যায়, তাহলে পরবর্তীতে হাঁটুতে ব্যথা ভোগ করতে হয়। ইনফেকশনের কারণেও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।
দেহের বড় বড় জয়েন্টের ভেতর এক প্রকার তরল পদার্থ থাকে যা জয়েন্ট নাড়াচাড়া করতে সাহায্য করে। এই তরল পদার্থ কমে গেলে জয়েন্টে ঘর্ষণ বেশি হয়। ফলে ক্ষয়ও বেশি হয়। আর ক্ষয় থেকেই ব্যথার সৃষ্টি হয়।
পেশাজনিত কারণ
হাঁটু ব্যথার কারণ পেশাও হতে পারে। যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করেন, সিঁড়ি দিয়ে অতিরিক্ত ওঠানামা করেন এবং অতিরিক্ত ভার বহন করতে হয় এমন কাজ করেন তাদের হাঁটুর ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এছাড়াও হাঁটু ব্যথার পেছনে জেনেটিক বা বংশগত কারণ, জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক বা ম্যালফরমড জয়েন্ট, হাঁটুর হাড় সরে যাওয়া ইত্যাদি কারণও দায়ী হতে পারে।
হাঁটু ব্যথার উপসর্গ
হাঁটু ব্যথার সবচেয়ে বড় ও সাধারণ উপসর্গ হলো হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভব করা। এছাড়াও কিছু উপসর্গ রয়েছে যা দেখে দিলে সচেতন হওয়া জরুরি। এগুলো হলো-
হাঁটু ফুলে যাওয়া
হাঁটুর সন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া
হাঁটুতে গরম অনুভব করা
হাঁটু লাল বর্ণ ধারণ করা
হাঁটু ব্যথা দেখা দিলে হাঁটাচলা বা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা হয়। এসময় হাঁটু ভাঁজ করলে শব্দ হতে পারে, ব্যথা অনুভূত হতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে।
হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা
দীর্ঘস্থায়ী হাঁটু ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে পরিবর্তন আর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক খাদ্যাভাস
হাঁটুর ক্ষয় রোধ করতে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, সি, ডি, ই সমৃদ্ধ খাবার হাঁটুর ক্ষয়রোধ করে। খাদ্যতালিকায় রাখুন বাদাম, গ্রিন টি, পালং শাক, ব্রকলির মতো খাবার। নিয়মিত ডিম, দুধ, মাখন, দই ইত্যাদি খেলে মিলবে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি যা হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে।
রোজকার খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন ফাংশনাল ফুড। দেখতে ওষুধ মনে হলেও যা পুষ্টিকর খাদ্য উপাদানের রূপান্তরিত রূপ। এটি মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণ তো করেই, সেসঙ্গে বিভিন্ন শরিরীক সমস্যার প্রশমনেও সহায়তা করে। এমনই একটি ফাংশনাল ফুড কারকুমা জয়েন্ট গার্ড। যা অস্থিসন্ধির সুস্থতা বজায় রাখতে বিশেষভাবে তৈরি। এই ফাংশনাল ফুডের প্রধান উপাদানসমূহ ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (USDA) অর্গানিক সার্টিফাইড।
ওষুধ
খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি চিকিৎসক হাঁটু ব্যথা কমাতে রোগীকে ওষুধ দিয়ে থাকেন। এছাড়া ক্ষয় পূরণের জন্য ডায়টারি সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।
ফিজিওথেরাপি
হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা হিসেবে ফিজিওথেরাপি বেশ কার্যকর ও জনপ্রিয়। এটি ব্যথা নিরাময় এবং জয়েন্টের স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনার একটি আধুনিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি। হাঁটু ব্যথা সারাতে আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি, টেনস থেরাপি, ইন্টার ফেরেনসিয়াল থেরাপি, লেজার থেরাপি ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। পাশাপাশি হাঁটুর শক্তি বাড়ানোর জন্য বিশেষ ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়।
সার্জারি
অনেকসময় হাড়ের ক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করার প্রয়োজন হয়।
ঘরোয়া টোটকা
হাঁটু ব্যথা করলে বরফ কিংবা গরম পানির সেঁক দিতে পারেন। এতে আরাম মিলবে। আঘাতের কারণে হাঁটু ব্যথা করলে বরফের সেঁক দিন। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা বা আর্থ্রাইটিসজনিত ব্যথা হলে গরম পানির সেঁক সবচেয়ে কার্যকর। বাজারচলিত কিছু মলম রয়েছে যা মালিশে হাঁটু ব্যথায় প্রশান্তি মেলে।
এসবের পাশাপাশি ওজন কমানো এবং দৈনন্দিন জীবনধারায় পরিবর্তন আনলে হাঁটু ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।