উৎপল রায় : প্রথম দেখা, ভালোলাগা, একদিনের প্রেম। তাতেই চিরজীবনের জন্য ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন শারীরিক প্রতিবন্ধী শফিকুল ইসলাম (৪৮) ও আঞ্জুয়ারা বেগম (৩৫)। তাও প্রায় দুই দশক আগে। ভালোবাসায় এই দীর্ঘ সময়েও চিড় ধরেনি এতটুকু।
যেখানে অন্য সব স্বাভাবিক নারী-পুরুষ স্বার্থ ও তুচ্ছ কারণে একজন আরেকজনকে ছেড়ে চলে যান, সেখানে তারা কেউ কাউকে ছেড়ে যাওয়ার কথা এই ২০ বছরে ঘুণাক্ষরেও কল্পনাও করেননি।
শফিক জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। বামন। উচ্চতা বড়জোর আড়াই ফুট। ছোট ছোট হাত-পা। হাঁটতে, চলতে কষ্ট হয়। ঠিকমতো বসতে পারেন না চেয়ার, চৌকি বা কোনো যানে। শারীরিকভাবে অক্ষমই বলা যায় তাকে। থমকে থাকা জীবন তার।
কিন্তু স্ত্রী আঞ্জুয়ারা আর দশটা নারীর মতোই স্বাভাবিক শারীরিক গঠনের অধিকারী হয়েও মেনে নিয়েছেন শফিককে। স্বামীর জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তার। সেই নিস্বার্থ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছেন শফিক ও তার তিন সন্তানকে। স্ত্রীর ভালোবাসায় নিজে বামন হওয়ার আজন্ম কষ্টের প্রায় সবটাই ভুলেছেন শফিক।
রাজধানীর শ্যামলীর আদাবর এলাকায় এমনই বিরল ভালোবাসার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া গেছে এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে। এলাকাবাসী বলছেন, বর্তমান সময়ের চাওয়া-পাওয়া, ভোগ ও স্বার্থবাদিতার ভালোবাসার যুগে শফিক ও আঞ্জুয়ারার ভালোবাসা বিরল।
আদাবরের ১৭/এ হিজড়া গলির ভাড়া করা একটি ছোট্ট কুঠুরিতে তিন সন্তানকে নিয়ে সংসার শফিক ও আঞ্জুয়ারার। অর্থের অভাবে বড় ছেলে আল-আমিন (১৬) ও মেয়ে আমেনার (১৪) পড়াশুনা বন্ধ। ছোট ছেলে আনোয়ার (১১) বাবা শফিকের মতোই জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী।
আনোয়ারকে নিয়ে শফিক বেরিয়ে যান সাতসকালে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে। সারাদিন ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পান রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভিক্ষা করে। এ দিয়েই চলে সংসার। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত আঞ্জুয়ারা। অর্থের অভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা।
কিন্তু সারাদিন ভিক্ষা করে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে গভীর রাতে ঘরে ফেরেন শফিক ও আনোয়ার। তখন হাসি ফুটে আঞ্জুয়ারার মুখে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত স্বামী ও সন্তানের মুখে তুলে দেন ভাত। তবে কখনো কখনো জোটে না তা। সেদিন খালি পেটে রাত কাটাতে হয় পুরো পরিবারটিকে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন শফিকুল ইসলাম ও আঞ্জুয়ারা বেগম। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বামনের সঙ্গে কিভাবে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ালেন এমন প্রশ্নে আঞ্জুয়ারা হাসেন।
তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর আগে এক সন্ধ্যায় নিজের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার জন্য রাজধানীর মহাখালীতে আসেন তিনি। তখন তিনি কিশোরী। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে রাত হয়ে গেলেও গন্তব্যের কোনো গাড়ি পাননি আঞ্জুয়ারা। খুঁজতে থাকেন রাতের আশ্রয়।
পাশেই শাহীন মার্কেটে গিয়ে কয়েকজনের কাছে রাতের আশ্রয় চান অসহায় আঞ্জুয়ারা। কিন্তু ঝামেলার ভয়ে এগিয়ে আসেনি কেউ। কেউ তাকিয়েছিলেন অন্যভাবে। এখানেই কাজ করতেন শফিক। একটি অসহায় কিশোরীকে আশ্রয় দেয়ার উদ্দেশ্যে এ সময় এগিয়ে আসেন শারীরিক প্রতিবন্ধী এ যুবক।
তবে কাকতালীয়ভাবে মনের ভয় ছিল দু’জনেরই। আঞ্জুয়ারার মনে তখন অন্য ধরনের ভয়। অন্যদিকে শফিকের আশঙ্কা ছিল, একটি অসহায় নারীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়েন! কিন্তু রাতের অন্ধকারে একটি কিশোরী মেয়ের করুণ আকুতি হৃদয় স্পর্শ করেছিল তার। তাকে আশ্রয় দেন।
পরদিন সকালে আঞ্জুয়ারার অনুরোধে তাকে ময়মনসিংহের নিজ গ্রামে দিয়ে আসার জন্য গাড়িতে উঠেন শফিক। আঞ্জুয়ারার হৃদয় স্পর্শ করে শফিকের এই উদারতা। তার মনে হয়, শারীরিক প্রতিবন্ধী বামন হয়েও একটি অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দেয়ার মতো দুঃসাহস যে দেখাতে পারে সেই সত্যিকারের পুরুষ। ভালো লেগে যায় শফিককে।
একসময় নিজের মনের অব্যক্ত বাসনা খুলে বলেন শফিককে। কিন্তু শফিক বিস্মিত! তার মতো একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বামনকে কোনো মেয়ে ভালোবাসতে পারে- তা তার কল্পনাতেও ছিল না কখনো। কিন্তু আঞ্জুয়ারার নির্মল ভালোবাসার কাছে হার মানেন শফিক।
সরাসরি তাকে নিয়ে যান নিজের এলাকা ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলায়। বাধে বিপত্তি। দুই পরিবারের বাবা, মা, ভাই-বোন, স্বজনদের দৃষ্টিতে এ রকম উদ্ভট ভালোবাসা ও বিয়েতে তারা কেউ রাজি নন। এক সময় পরিবারের সবার অমতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন দু’জন।
বিধি-সম্মতভাবে বিয়ে করেন শফিক ও আঞ্জুয়ারা। তারা জানান, বিয়ের দিন থেকেই নানা কটূ কথা শুনতে হয়েছে তাদের। পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক একপ্রকার শেষ হয়ে যায়। দুই পরিবারের কেউ এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি।
বিশেষ করে আঞ্জুয়ারার পরিবার তো হতভম্ব! এমন একটি মেয়ে কিনা বামন এক যুবককে বিয়ে করে ফেলবে তাদেরই অমতে। তাই একপ্রকার ত্যাজ্য করেন তারা আঞ্জুয়ারাকে।
উপায়ন্তর না দেখে তাদের কাছে স্বপ্নের শহর ঢাকাতেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন তারা। মিরপুর, শ্যামলী হয়ে প্রায় একযুগ ধরে বাস করছেন আদাবরের এই গলিতে।
একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী বামনকে ভালোবাসতে ও বিয়ে করতে গিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল কি-না এমন প্রশ্নে আঞ্জুয়ারা জানান, তখন ভালোবাসাটাই ছিল সবার আগে। তিনি জানতেন শফিককে বিয়ে করলে অন্তত মনের দিক থেকে সুখী হবেন তিনি।
তবে মানুষের নানা কটু কথা শুনতে হবে। এখনো দু’জনের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলে লোকে হাসাহাসি করে। তিনি জানান, প্রতিবন্ধী শফিককে ভালোবাসতে গিয়ে বিয়ে করে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়েছে সেই কবে।
অনেকেই ডিভোর্সের কথা বলেছিল। কিন্তু তাতে তিনি কর্ণপাত করেননি। আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ভালোবাসা ভালোবাসাই। শুরুর সময় একজন আরেকজনকে ছাইড়া যাইনি, এহনতো বয়স বাড়তাছে, শরীরে নানা অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধছে। তাছাড়া পোলাপানও বড় হইছে। কম খামু, কিন্তু সারাজীবনই স্বামী আর আমার সন্তানরে ভালোবাসতে চাই।
নিজের চাইতে কয়েক গুণ বেশি উচ্চতার আঞ্জুয়ারাকে ভালোবাসতে গিয়ে কখনো কোনো গ্লানি বা অপরাধবোধে ভুগেছেন কি-না- এমন প্রশ্নে শফিক জানান, বিয়ের পর যখন যেখানে গিয়েছেন এই দীর্ঘ সময়ে তাদের নানা কটাক্ষ, কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে প্রায় সবাই।
মানুষের মুখরোচক কথা ও কটূক্তির কারণে একসময় স্ত্রীকে নিয়ে বাসা থেকেই বেরুতেন না তিনি। শফিক জানান, প্রেম ও বিয়ের পর কিছুটা অপরাধবোধেও ভুগেছেন তিনি। নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে একজন সুস্থ সবল নারীর সঙ্গে ভালোবাসা ও সংসার করার গ্লানিতে ভুগেছেন দীর্ঘদিন।
কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসা সাহস দিয়েছে তাকে। শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ভালোবাসা দেইখ্যা এহন আর কেউ কিছু বলে না। সবাই আমারে পছন্দ করে। এইটা-সেইটা দেয়। সারাজীবন আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এভাবেই জীবন কাটাইয়া দিতে চাই।
আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভ্যালেন্টাইন্স ডে। দিবসটি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি-না বা এ উপলক্ষে দু’জনের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না-জানতে চাইলে শফিক ও আঞ্জুয়ারা অভিন্ন সুরে বলেন, ভালোবাসা দিবস কি? শুধু আইজ না, প্রত্যেকদিন আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে চাই।
শফিক আঞ্জুয়ারার বাসার পাশের বাসিন্দা স্থানীয় ওয়ার্ড শ্রমিক লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী মো. সাঈদ বলেন, ভালোবাসা আসলে মনের ব্যাপার। এই দু’জনের সত্যিকারের মন আছে। আমাদের সমাজে শারীরিক প্রতিবন্ধী কোনো নারী ও পুরুষ কেউ কাউকে গ্রহণ করে না। এক্ষেত্রে তারা ব্যতিক্রম।
দীর্ঘদিন থেকেই এদের দেখে আসছি। অভাব-অনটনেও তাদের একজনের প্রতি আরেকজনের ভালোবাসা সত্যিই দেখার মতো।
ভোগ-বিলাসিতা ও স্বার্থবাদিতা ছাড়াও যে ভালোবাসা যায় এ দু’জন তার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী জিয়াউর রহমান বলেন, অভাবের সংসার। কখনো কখনো অল্পকিছু কলহ হয়। কিন্তু ভালোবাসার কাছে সব হার মানে।
এলাকার গৃহিণী জাহানারা বেগম বলেন, ভিক্ষার সংসার। মাঝে-মধ্যে চুলার হাঁড়িতে চাল উঠে না। কোনোদিন না খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু ওদের সংসারে আদর-ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম