মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৭:৪৬:৪৮

ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র, নাগরিক মাত্র দুইজন!

ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র, নাগরিক মাত্র দুইজন!

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : স্বামী ও স্ত্রী দুই জন মিলেই একটি রাষ্ট্র। তাও আবার লেবাননের দক্ষিণ তীরবর্তী ইসরায়েলের উপকূলবর্তী রাষ্ট্র। ইসরায়েলের সংসদীয় নির্বাচনে সমগ্র দেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে মনোনিত করবেন। তবে এর ব্যতিক্রম ইসরায়েলের উত্তরে এই ক্ষুদ্র অঞ্চলটি, যা থাকে পুরোপুরি ভোটের আওতা মুক্ত।

শুধু আজ নয়, বিগত ৪০ বছর যাবত দেশটিতে যত নির্বাচন হয়েছে তাতে সবাই অংশগ্রহন করলেও এই ক্ষুদ্র অঞ্চলটি অংশগ্রহন করেনি। বলা যায়, ইসরায়েলের ভেতর থাকা স্বত্ত্বেও এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘদিন।

লেবাননের দক্ষিণের তীরবর্তী ইসরায়েলের উপকূলবর্তী ওই অঞ্চলটির নাম আচিভল্যান্ড। গোটা অঞ্চলটি লোহার পুরু দরজা এবং বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে ঘেরা। অনেক দূর থেকে পর্যটকরা স্থানটিতে ঘুরতে আসলেও স্রেফ বিশাল লোহার দরজার বাইরে থেকে ফিরতে হয়। হয়ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এরকম একটি স্বাধীন ভূখন্ড আছে যা কল্পনা করাই যায় না। তার উপর এই ভূখন্ডের আছে তাদের নিজস্ব পতাকা(মৎসকুমারী) এবং নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত। সবচেয়ে বড় কথা এর আছে একেবারেই ভিন্নধর্মী একটি সংবিধান। যে সংবিধানের আওতায় এখানে নির্বাচনও হয় এবং একজন প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়।

আচিভল্যান্ডের আছে নিজস্ব সংসদ ভবন। একটি মাত্র কাঠের চেয়ার এবং টেবিল সম্বলিত এই সংসদে কোনো মন্ত্রী বা সাংসদ নেই সত্যি, কিন্তু নিয়ম করে প্রেসিডেন্ট ঠিকই সংসদ অধিবেশনে বসেন। এই সংসদ থেকেই প্রেসিডেন্ট নিজ ক্ষমতা বলে তৈরি করেছেন ডাকটিকিট এবং পাসপোর্ট। এই রাষ্ট্রের পাসপোর্ট না থাকলে কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয় না। একবার ইসরায়েলের কয়েকজন সাংসদ একবার এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিতে ঢোকার চেষ্টা করলে বন্দুকের গুলির মুখে ফিরে আসতে হয়। পরবর্তীতে এই রাষ্ট্র থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে গুলি চালানো হয়েছে।

পাঠক হয়তো গুলিয়ে ফেলছে, রাষ্ট্র ছোটো হলেও তার জনগন থাকবে, থাকবে পুলিশ-সেনাবাহিনী ইত্যাদি সব বন্দোবস্ত। কিন্তু আচিভল্যান্ডে এসবের কোনো বালাই নেই। এমনকি নেই কোনো জনগণ। আলী আভিভি নামের ৮৫ বছর বয়সী এক ব্যাক্তি ও তা স্ত্রী দুজনে থাকেন এই রাষ্ট্রে। তিনিই এই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা অধিকারী।

সাদা চুল-দাড়ি এবং মেঘপালকদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কাফতান পরিধান করেই তিনি এই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। আভিভির বসবাসের প্রসাদটিও দেখতে ভিন্ন। ছোট একটি কাঠের ঘর হলো তার প্রাসাদ। ঘরে কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকায় তেমন কোনো অসুবিধা হয় না আভিভির, কারণ কাছেই সমুদ্র থাকায় এর শীতল বাতাসে গোটা বছরই আরামে কেটে যায় তাদের। ১৯৫০ সাল থেকে ক্রমাগত চেষ্টার ফলে তিনি এই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা করতে সমর্থ্য হয়েছেন।

ইরানী বংশভূত আভিভি বলেছিলেন, ‘আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে আমার অনেক ঝামেলা হচ্ছে। তারা চায় না আমি বেঁচে থাকি, তারা যেকোনো মূল্যেই আমাকে এই স্থান থেকে উৎখাত করতে চায়। এটা অনেকটা ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে আমার যুদ্ধের নামান্তর।’

যখন মাত্র দুই বছর তখন ইরান থেকে বাবার হাত ধরে সাগর পাড়ি দিয়ে ফিলিস্তিনে আসেন আভিভি। সেসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশগ্রহন করেছিলেন তিনি। তার বয়স ১৫ হতে না হতেই ইহুদিদের গোপন নৌ-বাহিনী ‘পালিয়াম’এ যোগ দেন তিনি এবং ইহুদি শরণার্থীদের গোপনে দেশে নিয়ে আসতে সাহায্য করেন তিনি।

এরপর রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল স্বাধীনতা লাভ করার পর আভিভি পুনরায় সাগরের কাছাকাছি ফিরে আসেন একজন নিতান্ত জেলে হিসেবে। একেএকে অনেক উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাকে। যে ইসরায়েলি বাহিনীকে তিনি যুদ্ধের সময় সহায়তা করেছিলেন সেই বাহিনীর সঙ্গেই কয়েক দফা বাদানুবাদ হয়ে যায় তার। অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ‘আল জিব’ নামের একটি পরিত্যাক্ত গ্রামের সন্ধান পান এবং অনেক ভেবেচিন্তে ওই গ্রামেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সেসময় তিনি তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের কাছে দুইটি ভবন ইজারা চেয়ে চিঠি লেখেন। তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাকে এই শর্তে ভবন দুটি ইজারা দিতে রাজি হয় যে, আভিভিকে ইসরায়েলের আভ্যন্তরীন গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করতে হবে। শর্তে রাজি হয়ে যান আভিভি, কারণ একা তার পক্ষে ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়।

প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আভিভি ওই অঞ্চলে ইসরায়েলি হিপ্পিদের আকর্ষিত করার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি দেখেছিলেন, স্থানটি সাগর তীরবর্তী হওয়ার কারণে অনেক তরুন তরুনী সময় কাটাতে এখানে আসেন। এই আগত হিপ্পি তরুন তরুনীদের কাছে রাতারাতি আভিভি জনপ্রিয় হয়ে যান। তৎকালীন সাংবাদিক শলোমো আব্রাহামোভিচ আভিভি সম্পর্কে বলেন, ‘মানুষ আসতো সাগর দেখতে। আর এটা একটা জায়গা ছিল যেখানে এসে আপনি যা চাই তাই করতে পারবেন। এটা সত্যিকার অর্থেই একটি স্বাধীন স্থান ছিল। আর আলী আভিভি ছিলেন বেশ ভরাট ব্যাক্তিত্বের অধিকারী।

১৯৭১ সালের দিকে আভিভির তৈরি করা বেড়া এবং বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙ্গে দেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এরপরই স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ওই স্থানটির নাম দেন আচিভল্যান্ড এবং নিজেদের ইসরায়েলি পাসপোর্ট ত্যাগ করে আচিভল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। এই ঘটনা পরবর্তীতে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়।

আদালতের বিচারপতি আভিভি দম্পতির স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার কথা শুনে চেয়ার ছুড়ে ফেলেন এবং ‘অনুমতি ছাড়াই দেশ তৈরির জন্য’ তিরস্কার করেন। তবে শেষমেষ পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলার কারণে এক লিরা জরিমানা করে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এই ঘটনায় প্রথম মিডিয়ার নজরে চলে আসেন আভিভি দম্পতি। আর এই অবস্থাটিকেই কাজে লাগান আলী আভিভি। তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন এবং নিজে বক্তব্য রাখেন।

সেই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘হয়তো ন্যাশনাল পার্ক তেলআবিবের জন্য প্রযোজ্য কিন্তু তেল আচিভের জন্য নয়।’ সেই সংবাদ সম্মেলণে যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাইকে আচিভল্যান্ডের সাংসদ হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি এবং সবাইকে স্বাধীন আচিভল্যান্ডের পক্ষে প্রচারণা চালাতে বলেন। মিডিয়া আচিলভ্যান্ডের পক্ষে লেখা শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও এই দাবির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে শুরু করে। এভাবেই আরও অনেক চড়াই উৎরাই এবং ঘটনার ভেতর দিয়ে আলী আভিভি এবং তার স্ত্রী স্বাধীন আচিভল্যান্ডকে বাঁচিয়ে রাখেন। নিজেও জনপ্রিয় হয়ে যান।

তার জনপ্রিয়তা যে শুধু ইসরায়েলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, হলিউডের তৎকালীন বিখ্যাত কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রীও তার ভক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পল নিউম্যান এবং সোফিয়া লরেন। প্রায়ই তারা আভিভির কাছে আসতেন সময় কাটানোর জন্য। আলী আভিভির স্ত্রীর নাম রিনা আভিভি। আচিভল্যান্ডের দ্বিতীয় সদস্য এবং ফার্স্ট লেডি। রিনার সঙ্গে ছিল সোফিয়া লরেনের খুবই ভালো সম্পর্ক।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে