মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৮:২৪:৪২

ঐতিহাসিক নলডাঙ্গা রাজ প্রাসাদ এখন ফসলের আবাদ!

জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ  থেকে: ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক নলডাঙ্গা রাজ প্রাসাদে এখন ফসলের আবাদ হয়। কয়েক বছর ধরেই সেখানে আবাদ হচ্ছে ফসলের। যার দরুন ঐহিহাসিক এই স্থানটিতে দর্শনাথীদের আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। রাজ্য রক্ষার জন্য যে রাজ্যে সৈন্য বাহিনী ছিল। যেখানে বসে পরিচালনা ও রক্ষা করা হতো রাজ্য।

সেই রাজ্যে এখন আর নেই। শুধু কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে আটটি মন্দির। তবে এই রাজবংশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিলিন হয়ে গেছে পাকিস্থান আমলেই। লোকমুখে এবং ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রায় পাঁচশত বছর আগে এই রাজ বংশের আদি পুরুষ ভট্রারায়ন ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধিন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তরাধীকারী সুরী বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরী করে হাজরা উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরী করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার নিকট খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন। এবং বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন।

১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিঞ্চদাস সন্যাসীকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান। এসময় বিঞ্চুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পার্শবর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। এই গ্রামগুলির সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারী এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই এলাকাটি নল নটায় পরিপুর্ন ছিল তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়। এরপর প্রায় তিনশত বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে এই রাজ বংশের শাসন করেন। এবং বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে বিলুপ্তপ্রায় মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করেন।

এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষন যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দ্বায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। এবং তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির যা কালের সাক্ষী হিসাবে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে। প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ট পুত্র। তিনি রাজ বংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষন মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারী ভার গ্রহন করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় । ১৯১৩ সালে তিনি রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগি হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধূমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২সালে রাজবাড়ির নিকট আজকের নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখন কালীগঞ্জে প্রান কেন্দ্রে অবস্থিত। রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রয়ারী ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেবরায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারী আদেশে অন্যান্য জমিদারীর মতো এই জমিদারীও সরকারের নিয়ন্ত্রনে চলে যায় এবং রাজ বংশ শেষ বারের মতো লোপ পায়। পরবর্তীতে কয়েক ৫০ বছর পার হলেও মন্দিরের কোন সংস্কার হয়নি তবে গত ২০০৬-০৭ ইং অর্থ বছরে সরকারী বরাদ্দকৃত ৭৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় শ্রী শ্রী লক্ষীদেবী মন্দির উন্নয়নের জন্য এবং শিব মন্দির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬৫ হাজার টাকা। এরপর স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, তারা মন্দির, দ্বিতল বিশিষ্ট বিঞ্চু মন্দির, সংস্কার কাজ ইতি মধ্যে শেষ করে। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন সংস্কারের উদ্দোগ নেওয়া হয়নি। স্থানটিতে আগে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটতো। সংস্কার আর যাতায়াতের সুব্যাবস্থা না থাকায় এখন দর্শনার্থীরা আসছেন না। দক্ষিণ পাশে বেগবতি নদীর উপর একটি ব্রীজ নির্মাণ হলে পার্শবর্তী কয়েকটি গ্রামের লোকজন সহজেই আসতে পারতো। দেশের প্রত্বতত্ত্ব বিভাগ অতি প্রাচীন এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যেগি হলে এটি হতে পারতো এক অমুল্য সম্পদ।'বৃক্ষটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। মূল বৃক্ষটি সময়ের পরিবর্তনে অনেকগুলো ছোট বৃক্ষে বিভক্ত হয়েছে।

মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ- পূর্ব পাশের বৃক্ষগুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। বৃক্ষটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং ৩৮টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। মূলবৃক্ষ এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা- প্রশাখায় ঘেরা। একসময় একটি কুয়ার পাশে ছিল এ বিশাল গাছের মূল অংশ। তখন আশপাশে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। রাস্তার ধারের এ গাছটির ডালপালা পূর্ণ থাকত সবুজ পাতায়। গাছের নিচে রোদ-বৃষ্টি কিছুই পড়ত না। মাঘের শীতের রাতেও গাছতলায় আবহাওয়া অন্যরকম থাকত। গ্রীষ্মকালে গাছতলা থাকত ঠাণ্ডা। গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত পথিকের দল।

এলাকার প্রবীণরা জানান, বর্তমানে সুইতলা নামের কোনো স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও ধারণা করা হয় পথশ্রান্ত পথিকরা এ মনোরম স্থানে শুয়ে- বসে বিশ্রাম নিত। তখন থেকেই অনেকের কাছে বিশাল বৃক্ষটি সুইতলা বটগাছ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর সেখান থেকেই এর নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ। বিশাল এ বটগাছটির জন্ম যে কুয়ার পাড়ে, সেটি কোথায় এবং কে খনন করেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও কারও কারও মতে, যে স্থানে কুয়া ছিল ওই জায়গাটি ১৯২৬ সালে রেকর্ডের আগে বেথুলী গ্রামের স্থানীয় ভূষণ সাহা পরিবারের কারও নামে রেকর্ড ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাসজমির অন্তর্ভুক্ত। কুয়ার পাড়ের বটগাছটি কালক্রমে 'ঝুরি' নেমে নেমে পাশের এলাকা দখল করে নিয়েছে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামের উত্তর- পশ্চিম কোণে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষটি অবস্থিত। কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বদিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া- খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন স্থানে এ প্রাচীন গাছটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছটিকে কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেথুলী বা মলিল্গকপুরের বাজার। পর্যায়ক্রমে বাজারের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে অনেকগুলো দোকান আছে এ বাজারে। প্রতি শনি ও বুধবার সাপ্তাহিক হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে এখানে। অনেকের মতে, দিনের বেলায়ও গভীর ছায়ায় প্রায় ঢাকা থাকত বটতলা। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তিই ছিল রায়গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৌলবালা সেনের নামে। পরবর্তী সময়ে খাস হয়ে যায়। হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগব্যাধি মুক্তির আশায় এ গাছের নামে মান্নত করে। পাখিদের অন্যতম একটি আবাসস্থল এ বটবৃক্ষটি। কিচিরমিচির শব্দ লেগেই থাকে। অথচ গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না।

কোনোদিন কেউ শকুন বসতে দেখেনি। গাছের নিচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না। বটতলায় কালীপূজার একটি স্থায়ী পাকা বেদি নির্মিত হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌরপদ অধিকারী ও হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এ বেদি নির্মিত হয়। এ বেদিতে সাড়ম্বরে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আগে এ গাছতলায় ১৫ দিনব্যাপী রাসপূজা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলক্ষে মেলা বসত। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষিত একটি বটগাছ। এ গাছটির আচ্ছাদন ছিল ২.২২ একর জমিজুড়ে। পরে ১৯৮২ সালে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রচারিত হয়, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) সেই বটগাছটি অপেক্ষা বড় এবং এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। 'বাংলাপিডিয়া' গ্রন্থে সুইতলা মল্লিককপুরের বটগাছটিকে 'বিশ্ববট' বলা হয়েছে। ২.৩৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ গাছের বিস্তৃতি। সুইতলা বটবৃক্ষটির অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কারও কাছে সুইতলার বটগাছ, কারও কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ, আবার কারও কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিত এটি। প্রকৃত পক্ষে এর অবস্থান বেথুলী মৌজায়। প্রায় ৩০০ বছর আগে এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে অযতœ, অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নানামুখী অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলিন হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন মিয়া জীবিত থাকাকালে এ গাছ দেখাশোনা করতেন স্বেচ্ছায়। তিনিই সর্ব প্রথম এখানে একটি দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন।

এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এখানে। গুরুত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃক্ষটির পাশে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলে সুইতলা মল্লিকপুরের এ বটগাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র।'নলডাঙ্গায় ছিল এক সময় রাজবাড়ি। ছিল সৈন্য- সামন্ত। এখন রাজা নেই। নৃত্যের শব্দও কানে আসে না। নেই এখানে রাজবাড়ি। আছে কিছু মন্দির। দালান ঘরের চিহ্ন। লোকমুখে শোনা যায়, রাজপ্রাসাদের চারদিকে ছিল পরিখা। বেগবতী নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল রাজপ্রাসাদের। সবকিছুই আজ বিলুপ্তপ্রায়। শুধুমাত্র চোখে পড়ে বেশ কিছু মন্দির। কালীগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে রাজবাড়ির অবস্থান। সেই রাজপ্রাসাদ আর রাজবংশের ইতিহাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বেগবতী নদীর ধারে বহুকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, গনেশ মন্দির, দুর্গা মন্দির, তারামনি মন্দির, বিঞ্চু মন্দির, রাজেশ্বরী মন্দিরসহ বিলুপ্তপ্রায় সুদৃশ্য ৮টি মন্দির। ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, তারা মন্দির, দ্বিতলবিশিষ্ট বিঞ্চু মন্দির সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এ মন্দিরের একটু উত্তর পাশেই রয়েছে প্রায় ৯ একরের সমান জলাধারা ।

কথিত আছে,এই জলাধারার পানি কখনো শেষ হয়না, এমনকি জলাধারায় মানষা করে অনেকে তাদের মনের ইচ্ছা এবং সমস্যা দূর হয়েছে। প্রায় পাঁচশ; বছর আগে এই রাজ বংশের আদি পুরুষ ভট্টরায়ন ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তরসূরি বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরি করে হাজরা উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার নিকট খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন এবং বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন। ১৫৯০ সালে মোগল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকাযোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসীকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় বিঞ্চুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্ন্যাসীকে আশপাশের পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। এই গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এ এলাকাটি নলনটায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়। এরপর প্রায় ৩শ’ বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে এই রাজবংশের শাসন করেন। ওই সময় মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষ্মারোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির, যা কালের সাক্ষী হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে।

প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজবংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারির ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায়। ১৯১৩ সালে রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধুমতি বৃত্তি চালু করেন। তিনিই ১৮৮২ সালে রাজবাড়ির নিকট আজকের নলডাঙ্গা ভূষণ হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেবরায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারির মতো এই জমিদারিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজবংশ শেষবারের মতো লোপ পায়। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরগুলো।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএসকে/

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে