এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যেখানেই যান নদীর দেখা মেলে। আমাদের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশে নদীর প্রভাব অনেক। কিন্তু আমাদের মানুষদের নানা কর্মকাণ্ডে দেশের অনেক নদীই আজ দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। শুনে অবাক হবেন, যেখানে পেয়েও আমরা মূল্য বুঝি না সেখানে বিশ্বের এমন কিছু দেশ আছে যেগুলোতে নদীই নেই।
এসব দেশকে পানি বিশুদ্ধকরণ, ভূগর্ভস্থ জলাধার, আমদানিসহ পানির বিভিন্ন বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। নদী নেই এমন কয়টি দেশের সঙ্গেই পরিচিত হব আজ।
মোনাকো
ইউরোপ মহাদেশের এ দেশটির জনসংখ্যা ৩৭ হাজারের আশপাশে। এর আয়তন শুনলে চমকে উঠবেন, কেবল দুই বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ আয়তনে স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভ্যাটিকান সিটি তার চেয়ে ছোট। আর তাই কম জনসংখ্যার দেশ হলেও মোনাকো খুব ঘনবসতিপূর্ণ এক দেশ।
এমন ছোট একটি দেশ, এখানে নদী না থাকাটা তো খুব অস্বাভাবিক না, কি বলেন? মোনাকোতে কোনো হ্রদও নেই। তবে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত দেশটিতে আছে দুটি বন্দর। আর তিন দিক থেকেই একে ঘিরে আছে ফ্রান্স। ইতালির সীমানাও বেশি দূরে নয়, মাত্র ১০ মাইল। দেশটি পর্যটকদেরও প্রিয় গন্তব্য এই মোনাকো। ক্যাসিনো ও ফর্মুলা ওয়ান রেসের জন্য বিখ্যাত মোনাকো ধনকুবেরদের খুব প্রিয় জায়গা। আর প্রচুর সংখ্যক পর্যটক আসায় দেশটির খাবার পানির চাহিদা বেশি। মূলত পানিকে লবণাক্ত মুক্ত করে এই চাহিদা পূরণ করা হয়।
সৌদি আরব
নদী নেই এমন সবচেয়ে বড় দেশ সৌদি আরব। ২১ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে মরুভূমি। মরু এলাকার বিস্তৃতি দেশটিতে নদী না থাকার অন্যতম কারণ। তবে এই প্রতিকূল ভূ-প্রকৃতির মধ্যেও দেশটির পানি ব্যবস্থাপনা চমৎকার।
নানা ধরনের পানির উৎস ব্যবহার করতে হয় এখানে জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত পানি সংগ্রহ করার জন্য। এগুলোর মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি, বৃষ্টির জল সংগ্রহ, পানির লবণাক্ততা মুক্ত করার কারখানা এবং পানির পুনর্ব্যবহার অন্যতম। দেশটির খাবার পানির ৭০ শতাংশই আসে সাগরের জল লবণাক্ততা মুক্ত করার মাধ্যমে।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ কম জনসংখ্যার দেশের তালিকায় আটে। জাতিসংঘের হিসেবে এখানে বাস করা মানুষের সংখ্যা ৪২ হাজারের কিছু কম। ওশেনিয়ায় অবস্থিত মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ৫টি তুলনামূলক বড় দ্বীপ ও ২৯টি অ্যাটোল (প্রবাল প্রাচীর বেষ্টিত উপহ্রদ) নিয়ে গঠিত। দেশটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১২২৯টি দ্বীপ আছে। এগুলোর বেশির ভাগ আয়তনে যে একেবারে ছোট তার প্রমাণ, সবগুলো দ্বীপ মিলিয়ে আয়তন ১৮১ বর্গ কিলোমিটার।
আর সাগরের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এমন একটি দেশে নদী না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতে দেশটির স্বাদু পানি নিয়ে বড় সংকটে পড়তে হয়েছে। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ স্বাদু পানি সংগ্রহের জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখে।
আরব আমিরাত
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও নদী নেই। ৮৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার মরুময় দেশটিতে অবশ্য বেশ কিছু ওয়াদি বা খাল আছে। তবে এসব খালে কেবল বর্ষাতেই পানি থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো গোটা দেশের পানি চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্প এবং কৃষির উন্নয়ন শুষ্ক দেশটিতে পানির বিপুল চাহিদা তৈরি করেছে। তবে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার, পানির লবণাক্ততা মুক্ত করার কারখানা স্থাপন এবং পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সমস্যাটি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। ভূগর্ভস্থ জলের একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় কৃষিতে।
মালদ্বীপ
পর্যটকদের খুব পছন্দের গন্তব্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ। ভারত মহাসাগরের প্রায় ১২০০ প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা দেশটির আয়তন মোটে ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। বুঝতেই পারছেন ছোট্ট এই দ্বীপ দেশটিতে নদী না থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
তবে বিপুল পর্যটকের উপস্থিতির কারণে দেশটিতে স্বাদু পানির চাহিদা অনেক বাড়িয়েছে। এখানকার অনেক দ্বীপে বসবাসকারী লোকদেরই আমদানি করা বোতলজাত জল এবং বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভূগর্ভস্থ জলের অধিকাংশই পানের উপযোগী নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে জাহাজে পানি পাঠানো ব্যয়সাপেক্ষ। তারা পানির লবণাক্ততা দূরের প্ল্যান্টের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।
ভ্যাটিকান সিটি
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিওর দেওয়া তথ্য বলছে, ভ্যাটিকান সিটির জনসংখ্যা ৫০০ ছুঁই ছুঁই। জনসংখ্যা ও আয়তন দুই দিক থেকেই ভ্যাটিকান সিটি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট স্বীকৃত রাষ্ট্র। ইতালির রোমের মধ্যে অবস্থিত দেশটির আয়তন ০.৪৪ বর্গ কিলোমিটার।
কিন্তু যতই ছোট দেশ হোক আর জনসংখ্যা যতই কম হোক ভ্যাটিকান সিটিরও তো পানির প্রয়োজন। আর এর জন্য তারা নির্ভরশীল রোমের পানি সাপ্লাইয়ের ওপর।
১৯২৯ সালে যখন ভ্যাটিকান সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়, একই সময়ে ইতালিতে রোমান ক্যাথলিক ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। পোপের বাসস্থান এবং পবিত্র তীর্থস্থান হওয়ার পাশাপাশি সিস্টিন চ্যাপেল, সেন্ট পিটারস স্কয়ার এবং সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ভূমধ্যসাগরের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার পরও মাল্টায় জল নিয়ে হাহাকার। আর এটা পানযোগ্য পানির জন্য। কারণ দেশটিতে কোনো নদী বা হ্রদ নেই। ভূগর্ভস্থ পানির উৎস ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহের মাধ্যমে স্বাদু পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয় দেশটিতে।
তবে ঘটনা হলো, ভূমধ্যসাগরের মধ্যে অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ৩১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে প্রচুর পর্যটকের আগমন হয়। আর দেশটি অনেকাংশেই এক পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে বিপুল পর্যটকের জন্য অনেক পানির প্রয়োজন হয়।
কৃষিকাজে ব্যবহার করা রাসায়নিকের কারণে ভূগর্ভস্থ জলও দূষিত। তাই লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়াও কাজে লাগানো হচ্ছে।
কাতার
১১ হাজার ৬৩৭ কিলোমিটার আয়তনের দেশটি তার তেল শিল্পের কারণে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে আছে। কিন্তু কোনো নদী না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার বেশ সমস্যায় আছে।
কাতারের স্বাদু পানির ৯৯ শতাংশ আসে পানি লবণাক্ততা মুক্তকরণের মাধ্যমে। তবে এটি ব্যয়বহুল এবং টেকসই প্রক্রিয়া নয়। লবণাক্ততা মুক্ত করার প্ল্যান্টের জন্য প্রচুর শক্তিরও প্রয়োজন হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক দেশের মতো কাতারেও ওয়াদি আছে। তবে এই খালগুলো দেশটির পানি সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এদিকে অল্প কিছু ওয়াদি ছাড়া কাতারে স্বাদু পানির আর কোনো উৎসই নেই। দেশটিতে টেকসই পানির উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জল পরিমিত ব্যবহারের দিকেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও একটিও নদী নেই এমন দেশের তালিকায় আছে কমোরোজ, জিবুতি, লিবিয়া, কিরিবাতি, নওরু, টোঙ্গা, ট্যুভ্যালু, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, ইয়েমেন প্রভৃতি। সূত্র: এমএসএন, টাইমস অব ইন্ডিয়া, উইকিপিডিয়া