পাল ও সেন যুগের ইতিহাসের স্মৃতির শহর
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে আছে, “বাম দিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী/ যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি।” একাদশ শতকের কুমারহট্ট থেকে একবিংশ শতকের হালিশহর— দীর্ঘ পথ চলার সাক্ষী শহরের গা ছুঁয়ে যাওয়া প্রবহমান গঙ্গা। প্রাচীন এই জনপদে গঙ্গা যেমন তার গতিপথ বদলেছে, তেমনি সময়ের সঙ্গে বদলেছে শহরের ইতিহাস।
পশ্চিমবঙ্গের কুমারহট্ট থেকে হাভেলিশহর, আর তার অপভ্রংশ হালিশহর। হাভেলিশহরের সীমানা ছিল কাঞ্চনপল্লি থেকে ইছাপুর খাল পর্যন্ত। পুরনো শহরে সৌধের শেষ ছিল না। বড় বড় মহল, অট্টালিকায় ভরা হাভেলিশহরের ইতিহাস পাল যুগের কথা বলে। পাল রাজাদের তৈরি নৌ বন্দর বা জাহাজঘাটা ‘নৌ-বিতান’-এর ইতিহাস এ শহরের স্মৃতিতে। তখনও হাভেলিশহরের জন্ম হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা তখন তাম্রলিপ্ত থেকে সরে এসেছেন গঙ্গার ও পারে সপ্তগ্রামে। আর এ পারে অধুনা হালিশহরে তৈরি হওয়া জাহাজঘাটা নৌ-বিতানে এ নিয়মিত আসতেন রাজা কুমার পাল। একটু একটু করে বসতি তৈরি হচ্ছিল এখানে। কথিত আছে, রাজা কুমার পাল এর নামে এই জনপদের নাম হয় ‘কুমারহট্ট’।
ইতিহাস বলে, মৃৎ শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান ছিল কুমারহট্ট। বজরায় করে এখান থেকে মাটির জিনিসপত্র যেত দূর-দূরান্তে। কুমোরদের হাট বসত এখানে। তার থেকেও ‘কুমারহট্ট’ নামকরণ হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান ছিল এই জনপদ। রাজকুমারেরা সংস্কৃতের পাঠ নিতে আসতেন বলে নাম ‘কুমারহট্ট’। তবে নাম নিয়ে প্রবাদ যাই থাক, বিভিন্ন পুঁথি ও দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজা কুমার পালের নাম থেকেই এই শহরের নামকরণের বিষয়টি যুক্তিসঙ্গত বলে ইতিহাস গবেষকদের দাবি।
পাল বংশের পর সেনরা শক্তিশালী হয়ে সপ্তগ্রাম দখল করে। রাজা বিজয় সেন এই কুমারহট্ট পরগনাতেই তৈরি করেন রাজধানী বিজয়পুর। যা আজকের বীজপুর। সেন যুগেরও অসংখ্য নিদর্শন এই শহরের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে। লক্ষ্মণ সেনের পরে ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান শাসকেরা সপ্তগ্রাম দখল করেন। ৫০টি মহাল-এ ভাগ হয়ে ‘সাতগাঁও সরকার’ নাম হয়। তারই মধ্যে একটি ছিল কুমারহট্ট। বর্গী হামলার পরে সেখান থেকে পালিয়ে বহু মানুষ কুমারহট্টে নতুন করে বসতি গড়েন। বিত্তশালী বহু মানুষ তখন এখানে উঁচু পাঁচিল ঘেরা প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন। তৈরি হয় বিভিন্ন সৌধ। ধীরে ধীরে কুমারহট্ট হাভেলিশহরে পরিণত হয়। সে কারণে এই শহরকে ‘সিটি অফ হাভেলিস’-ও বলা হত।
ধর্মের দিক থেকে হালিশহর চিরকালই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের শহর। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের পরে গোঁড়া শৈব মতাবলম্বী সেনরা রাজত্ব চালান। তাই হালিশহরে শিব মন্দিরের ভগ্ন স্তূপের শেষ নেই। পরবর্তীতে এই সেন রাজারাই শাক্ত মতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। দেবী মূর্তি পুজোর প্রচলন শুরু হয়। প্রবল কৌলিন্য প্রথার মধ্যে দিয়ে চলা হালিশহরের সংস্কৃতিতে ধর্মান্ধতার গ্লানি যখন চেপে বসেছে, তখন বৈষ্ণব ধর্মের পথিকৃৎ চৈতন্যদেবের দীক্ষা গুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর উত্থান হয়।
এই শহরেই তার জন্মভিটেতে এখন রাজ্যের অন্যতম বৈষ্ণব পাঠাগার। চৈতন্যদেবের পদধূলি হালিশহরের বুক জুড়ে। গুরুর ভিটে থেকে চৈতন্যদেব এক মুঠো মাটি তুলে নেওয়ার পরে তার ভক্তেরাও ওই পুণ্য মাটি মুঠো ভরে নিতে থাকেন। তৈরি হয় ‘চৈতন্য ডোবা’। হালিশহরে সাধক রামপ্রসাদের ভিটে। কবি রামপ্রসাদ সেন ১৭২০ সালে এই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রামপ্রসাদের ভিটেতে কালীবাড়ির জন্যই হালিশহর একটি সিদ্ধপীঠ। স্থানীয় বাসিন্দাদের উষ্মা, দক্ষিণেশ্বর বা তারাপীঠের মন্দির যে ভাবে প্রচার পায়, সে ভাবে এই মন্দিরটির প্রচার নেই। প্রতি বছর কালী পুজো হয় ধুমধাম করে। রানি রাসমনির জন্মস্থান এই হালিশহর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি, বাঁধানো ঘাট এখনও টিঁকে আছে কোনও রকমে।
হেরিটেজ কমিটি’র সদস্য, ব্যারাকপুর মহকুমার ইতিহাস গবেষক মাধব ভট্টাচার্য বলেন, “হিন্দু রাজাদের সময় যেমন অসংখ্য মন্দির তৈরি হয়েছিল, প্রাচীন এই জনপদে মুসলমান শাসনের সময়ে বেশ কিছু মসজিদ ও দরগাও তৈরি হয়। ১৬৮০ সালে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত বাগের মসজিদ।”
হালিশহর নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার কাজ করেছেন অলোক মৈত্র ও নজরুল বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্ত। তারা জানালেন, প্রায় তিনশো বছর ধরে খাসবাটি অঞ্চলে পুজো হয় শ্যামাসুন্দরীর। অকিঞ্চন ব্রহ্মচারী নামে এক কালী উপাসক এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। বলিদাগাটার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরটিও গঙ্গাপাড়েই গড়ে উঠেছে। গঙ্গা থেকে পাওয়া কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি এই বিগ্রহটি।
এর থেকেই এখানে কালীকাতলা নামটি চালু হয়। পুরনো স্থাপত্যের মধ্যে বারেন্দ্র গলির প্রাচীন টেরাকোটার মন্দির এখানে বিখ্যাত। মন্দিরটি তার অসাধারণ কারুকার্যের জন্য খ্যাতি লাভ করেছে। বুড়োশিবের পরিচয় পাওয়া যায় ঋকবেদে। এই হালিশহরের বাসিন্দা ছিলেন সাবর্ণ চৌধুরী। এখনও তাদের অট্টালিকা আছে। সাবর্ণ চৌধুরীর বংশধর বিদ্যাধর রায়চৌধুরী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
হালিশহরের বাসিন্দা ছিলেন বিপ্লবী বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়। শৈশবে মায়ের সঙ্গে রামপ্রসাদের সাধন পীঠে যেতেন তিনি। সেখানে রামপ্রসাদের বিভিন্ন গান থেকেই তিনি বিপ্লবী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বীজপুরের প্রথম বিধায়কও হয়েছিলেন।
শরীর চর্চা ও বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির জন্য তিনি ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ গড়ে তোলেন। তারই সংস্পর্শে এসে দেশপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেন সুশীলকুমার ঘোষ। দাঙ্গার বিরুদ্ধে বৈঠক করতে গাঁধীজি কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন। সে সময়ে সুশীল ঘোষের নেতৃত্বে দলে দলে কংগ্রেস কর্মীরা ওই সভায় যোগ দেন। নেতাজিও এখানে মাঝে মাঝে আসতেন বলে জানা যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলামও হালিশহরে এসেছিলেন।
২২ সেপ্টেম্বর২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস