মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৩৬:৫৯

যশোরের হারানো ইতিহাস উদ্ধার

যশোরের হারানো ইতিহাস উদ্ধার

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : যশোর নামে একটি রাজ্য ছিল। কিন্তু আজকের যশোর স্বনামের সেই রাজ্যটি হারিয়ে নিঃস্ব। যুক্তবাংলার প্রথম ও বৃহৎ জেলা আজ অতি ক্ষুদ্রাকৃতির যশোর। এই যশোরের গর্ভের সন্তান খুলনা মহাকালের সিঁড়ি বেয়ে বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত। বঞ্চনা বৈষম্যের অক্টোপাসে আবদ্ধ সমৃদ্ধ জনপদ যশোর ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে আজ এক গরিব গাঁ। 'একে একে নিবিছে দেউটি'র মতো যশোরের সব কিছু যখন নিবে গেছে তখন সেই গৌরবদীপ্ত ইতিহাস তুলে এনে যশোর জেলা পরিষদের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী এসএম নূরুল ইসলাম এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জেলা পরিষদের ১২৭ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে তিনি এই কাজটি করেন। যশোর জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ এসব দুর্লভ তথ্য-উপাত্ত শতবর্ষী স্মরণিকায় প্রকাশ করায় প্রকাশনাটি যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে তেমনি কর্তৃপক্ষ প্রশংসিত হয়েছে।

তিনি জানান, কাজ করতে গিয়ে জেলা পরিষদের রেকর্ডরুমে খুঁজে পান উইপোকায় খাওয়া জরাজীর্ণ মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অবিভক্ত যশোর জেলার মানচিত্র। যশোর নামে আগে একটি রাজ্য ছিল। ১৭৮১ সালে ব্রিটিশ সরকার যশোর রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে অভিভক্ত বাংলায় যশোরকে প্রথম জেলা ঘোষণা করে। সে সময় নদীয়া, ২৪ পরগনা, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও পাবনার অধিকাংশ এই যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে যশোরকে খ-িত করা হলেও বনগাঁ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সে মানচিত্রটিও তিনি খুঁজে পেয়েছেন। নূরুল ইসলাম জানান, একটি ঐতিহাসিক ছবি তিনি ছয় মাস ধরে চেষ্টা করে ভারত থেকে সংগ্রহ করেছেন।

আজকের খুলনা জেলা এক সময় যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই খুলনাকে মহকুমা করা হয় যশোর জেলা সৃষ্টির ৬১ বছর পর ১৮৪২ সালে। এরও ৩৯ বছর পর অর্থাৎ যশোর জেলা প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পর খুলনাকে জেলা করা হয়। তিনি খুঁজে পেয়েছেন যশোর-খুলনার যুক্ত মানচিত্রটি। এই মানচিত্রগুলো গবেষকদের কাছে অনন্য দলিল হিসেবে ইতোমধ্যে সমাদৃত হয়েছে।

লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিল জেলা পরিষদে সেবাদানকারী ১০ জন চেয়ারম্যান ও ১৩ জন ভাইস চেয়ারম্যানের নাম-পরিচয়। তিনি প্রায় সবার ছবিসহ পরিচিত এবং স্বাক্ষর উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। একই সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রকৌশলীদেরসহ সেবাদানকারী অন্যদের নাম পরিচয় তিনি উদ্ধার করেছেন। নূরুল ইসলাম রেকর্ডরুম ঘেঁটে ধুলাবালির স্তূপের ভেতর থেকে সবার ছবি এবং পরিচিতি খুঁজে বের করেছেন খুবই জরাজীর্ণ অবস্থায়।

১৮৮৫ সালের লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় জেলা বোর্ড সৃষ্টি করা হয়। এর এক বছর পর ১৮৮৬ সালের ১ অক্টোবর যশোর জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৫৯ সালে নামকরণ করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার আইনে জেলা পরিষদ নামকরণ হয়। বর্তমানে জেলা পরিষদ আইন ২০০০ (২০০০ সালের ১৯ নম্বর আইন) অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এর ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯১৩ সালে। ওই বছর ৩ মার্চ এ ভবন উদ্বোধন করেন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঔঐ খরহফংধু ঊংয় (গঅ ওঈঝ). এসব তথ্য কারো জানা ছিল না। কোন বইপুস্তকেও নেই। নূরুল ইসলাম সবই উদ্ধার করে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে ১৯৪১ সালের ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত যশোর জেলা পরিষদের সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবের একটি কপি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠানো হয়। পত্রটি পেয়ে তিনি সাধুবাদ জানিয়ে জেলা পরিষদকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিটি জেলা পরিষদের ১৩ সেপ্টেম্বরের সভার কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করা হয়। উদ্ধারকৃত সেই চিঠি ও কার্যবিবরণীকে গৌরবময় স্মৃতি হিসেবে সুধীজন মূল্যায়ন করছেন।

আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের পরিচালক অদুদুল বারী চৌধুরী জানান, নূরুল ইসলামের পরিশ্রমের ফল পাঠক, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের দুষ্প্রাপ্য তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ডিন প্রফসর ড. অনিক মাহমুদ বলেন, নূরুল ইসলাম অসাধ্য সাধন করেছেন। দুষ্প্রাপ্য তথ্য-উপাত্ত ভবিষ্যতে গবেষকদের গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে।

ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ফেলো প্রফেসর শাহ আলম বলেন, একটি তথ্যের জন্য শত জায়গায় ঘুরতে হয়। নূরুল ইসলাম যা করেছেন তা অবিস্মরণীয়।

নূরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় আর্কাইভসে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ঐতিহাসিক বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর জেলা পরিষদের গৌরবময় ইতিহাস উদ্ঘাটনে তিনি আগ্রহী হন। এ কাজে জেলা পরিষদের প্রশাসক শাহ হাদিউজ্জামান, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমদ ও বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার বণিক তাকে প্রেরণা জোগান। নূরুল ইসলাম জানান, যশোর জেলা পরিষদে এখনও যে ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ ডকুমেন্টস জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে তা সংরক্ষণের জন্য একটি আর্কাইভস তৈরি করা জরুরি।

এসএম নূরুল ইসলাম বুয়েট থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে এলজিইডিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৯ সালে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন যশোর জেলা পরিষদে। তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের লাইফ ফেলো। তিনি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মুণ্দুমালা গ্রামের বাসিন্দা। -আমার যশোর
২২ সেপ্টেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আল-আমিন/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে