এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। কয়েকটি দেশে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতার পালাবদল প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। কোথাও বিতর্কিত পরিস্থিতিতে সম্পন্ন হয়েছে নির্বাচন। কোথাও জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের। এর মধ্যে এশিয়ায় ভারত ও আফগানিস্তানের নির্বাচন বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মিশরের নির্বাচন আর লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল নির্বাচন ছিল আলোচিত। এছাড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নির্বাচন।
আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: এ বছর আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ। এক দশক পর ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে দেশটিতে। আফগানরা বেছে নিয়েছে হামিদ কারজাইয়ের উত্তরসূরিকে। ৫ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা সম্পন্ন হয়। এতে কোন প্রার্থী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় শীর্ষ দুই প্রার্থী আশরাফ গনি এবং আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হয় ১৪ই জুন। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগের কারণে ফল প্রকাশ বিলম্বিত হয়ে পড়ে।
অবশেষে ১৯শে সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশন আশরাফ গনিকে জয়ী ঘোষণা করে। এর পাঁচ ঘণ্টা পর গনি ও আব্দুল্লাহ নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়ার একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করেন। এতে শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব পান আব্দুল্লাহ। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপস্থিতিতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষমতার পালাবদল সম্পন্ন হয় এ নির্বাচনের মাধ্যমে। এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয় আফগানরা। অনেক ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। আফগানিস্তানে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখ। এছাড়া অভিবাসী আফগানদের মধ্যে ভোটাধিকার রয়েছে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের।
ভারতের লোকসভা নির্বাচন: এ বছর ভারতের ১৬তম লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের ১০ বছরের শাসনামলের ইতি টেনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয় ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদি। দীর্ঘ ১৩ বছর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন। ২৬শে মে শপথ নেন ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। মোদি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত সকল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় চীন সফরে থাকার তার পরিবর্তে শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মাননীয় স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০০২ সালে সেখানকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবার কারণে মার্কিন সরকার মোদির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ২০০৫ সালে। লোকসভা নির্বাচনে মোদির নির্বাচিত হওয়াটা যখন আগে থেকেই অনুধাবন করা যাচ্ছিল তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার আভাস। আর শপথ গ্রহণের পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে আসে শুভেচ্ছা বার্তা এবং যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ। মোদি সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন। শীতল হয়ে পড়া মার্কিন-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ভারতে এ বছর লোকসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয় মোট নয় দফায়।
৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে পর্যন্ত। ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী যোগ্য ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮১ কোটি ৪৫ লাখ। এর ফলে ওই নির্বাচন শুধু ভারতেরই ৯ বিশ্বের সব থেকে বড় নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। লোকসভার ৫৪৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট ৮২৫১ জন প্রার্থী। নির্বাচনে গড় ভোটর উপস্থিতি ছিল ৬৬.৩৮ শতাংশ। ৯৮৯টি কেন্দ্রে ভোট গণনার পর ১৬ই মে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়। এতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) জোট ৩৩৬টি আসনে জয়ী হয়। বিজেপি এককভাবে জয়ী হয় ২৮২টি আসনে (৫১.৯%) ভারতে ১৯৮৪ সালের পর এবারই প্রথম কোন দল অন্য কোন দলের সহায়তা ছাড়া সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠা লাভ করে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট মাত্র ৫৮টি আসন পেতে সক্ষম হয়েছিল।
মিশরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মোরসিকে আগের বছর সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য নিয়ে উৎখাতের পর এ বছর অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২৬শে থেকে ২৮শে মে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন মাত্র দু’জন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে সেনাপ্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করা আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং অপর প্রার্থী ছিলেন হামদিন সাবাহি। ২১শে মে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন কমিটি সিসিকে জয়ী ঘোষণা করে। তিনি মিশরের ৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে বলা হয় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪৭.৫ শতাংশ ( আনুমানিক ২ কোটি ৫৬ লাখ)। মোহাম্মদ মোরসির মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: ৯ই জুলাই ইন্দোনেশিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় দেশটির তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনে সাবেক জেনারেল প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জাকার্তার সাবেক গভর্নর এবং সুরাকার্তার সাবেক মেয়র জোকো উইডোডো। ছেলেবেলা থেকে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হওয়া উইডোডোর দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথে সংগ্রামের উত্থান শিরোনাম হয় বিশ্বমিডিয়ায়। ২২শে জুলাই দেশটির নির্বাচন কমিশন তার জয় ঘোষণা করে। তিনি ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কাল্লা ২০শে অক্টোবর ৫ বছর মেয়াদে শপথ গ্রহণ করেন। ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক বাহিনী বা অভিজাত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বাইরে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো।
ইউক্রেনে দুই নির্বাচন: রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল আর পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংসতায় সারা বছরই আলোচনায় ছিল ইউক্রেন সঙ্কট। এরই মধ্য দিয়ে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং সংসদীয় নির্বাচন। ২৯শে মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ইউক্রেনে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণে তা অনুষ্ঠিত হয় ২৫শে মে। নির্বাচনে ৫৪.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন পেত্রো পোরোশেঙ্কে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউলিয়া তাইমোশেঙ্কো পান ১২.৮১ শতাংশ ভোট। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের কিছু বেশি। পোরোশেঙ্কো নির্বাচিত হন ৫ বছর মেয়াদে। সংসদ সক্রিয় হয় ২৭শে নভেম্বর থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন: ৪ঠা নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এতে রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদে তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করার পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয় সিনেটেও। এর ফলে, ডেমোক্রেট নেতা বারাক ওবামা দেশটির প্রেসিডেন্ট হলেও কংগ্রেসে আধিপত্য এখন রিপাবলিকানদের। প্রতিনিধি পরিষদে ২৪৭টি আসন (৫৬.৭৮%) এবং সিনেটে ৫৪ আসন নিয়ে ১৯২৯ সালের ৭১তম কংগ্রেসের পর এখন সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের। সিনেটের ক্লাস টু’র ৩৩টি আসনের সবকটিতে নির্বাচন হয়। এছাড়া ক্লাস থ্রি’র তিনটি শূন্য আসনে প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট বিশেষ নির্বাচন হয়। ৩৬টি আসনের দৌড়ে রিপাবলিকানরা জয়ী হন ২৪টিতে। আগের থেকে ৯টি আসন বেশি পান তারা। আর ডেমোক্রেটরা জয়ী হন ১২টিতে।
ব্রাজিলের সাধারণ নির্বাচন: ৫ই অক্টোবর ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচনে। প্রথম দফায় কোন প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় ২৬শে অক্টোবর শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফা রান-অফ। ব্রাজিলের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসিও নেভেসের থেকে ন্যূনতম ব্যবধানে জয়ী হন। প্রেসিডেন্ট পদে দিলমা রুসেফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আরও ১১ প্রার্থী। এর মধ্যে সবথেকে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন মিনাস গেরেইসের সিনেটর এবং স্যোশাল ডেমোক্রেসি পার্টির এসিও নেভেস এবং সোসালিস্ট পার্টির মারিনা সিলভা। রান অফে দিলমা পান ৫১.৬ শতাংশ ভোট আর নেভেসের পক্ষে আসে ৪৮.৪ শতাংশ। মানবজমিন