শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৬:২২:৫৯

জীবনের শেষ দিনগুলো যেভাবে কেটেছিল ক্ষমতাহারা কর্নেল গাদ্দাফির

জীবনের শেষ দিনগুলো যেভাবে কেটেছিল ক্ষমতাহারা কর্নেল গাদ্দাফির

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি। লিবিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি। একটা সময় তিনি আর লিবিয়া একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আরব বসন্তের রেশ ধরে তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। নিহত হওয়ার আগে তাকে বেশ কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। 
এখানে তার ওই জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

গাদ্দাফির শেষ দিনগুলো কাটত সিরতের মানুষের পরিত্যাক্ত বাড়িগুলোতে আত্মগোপন করে, মানুষের রেখে যাওয়া খাবার খেয়ে। সিরতে গাদ্দাফির কোনো সেফ হাউজ বা ভূ-গর্ভস্থ নিরাপদ আশ্রয় ছিল না। গাদ্দাফি এবং তার সঙ্গীসাথীরা সিরতের ডিস্ট্রিক্ট টু-এর পুরানো আমলে তৈরি একতলা বাড়িগুলোতেই আশ্রয় নিতে থাকেন।

দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার কারণে তাদের তখন যথেষ্ট খাবারও ছিল না। তারা এলাকার মানুষের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে যেসব খাবার পেতেন, সেগুলো খেয়েই জীবন ধারণ করতেন। অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে কোনো গোশত বা সব্জি ছাড়া শুধু ভাত এবং মাকরোনা (পাস্তা) খেয়ে দিন কাটাতে হতো। লিবিয়ানদের প্রধান খাবার রুটি বানানোর মতো ময়দাও তাদের সংগ্রহে ছিল না। গাদ্দাফির জন্যও পৃথক খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অন্য চার-পাঁচজনের সাথে একই পাত্রে একই খাবার খেতেন গাদ্দাফি।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গাদ্দাফির সাথে থাকা চাচাতো ভাই মানসুর দাওয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, গাদ্দাফি দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন নামায এবং কুরআন শরিফ পড়ে। শহরে তখন বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সংযোগ- কিছুই ছিল না। 

পুরো পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় তিনি টেলিভিশন দেখে সংবাদও জানতে পারতেন না। মাঝে মাঝে তিনি তার স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে খোঁজ-খবর জানার চেষ্টা করতেন। এর বাইরে তার আর কোনো কাজ ছিল না। গাদ্দাফি এবং তার ঘনিষ্ঠদের সময় কাটত শুয়ে-বসে।

ন্যাটোর বিমান হামলার ভয়ে গাদ্দাফি এবং সঙ্গীরা এক বাড়িতে বেশি দিন থাকার ঝুঁকি নিতেন না। তারা প্রতি চার-পাঁচ দিন পরপর বাসা পরিরর্তন করতেন। তারা অপেক্ষা করতেন, কোনো বাসার অধিবাসীরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তাদের বাসায় গিয়ে উঠতেন। এলাকার মানুষ যদিও গাদ্দাফীর অবস্থানের কথা জানত না, কিন্তু তারা জানত, এলাকার গেরিলা যোদ্ধাদের বাসাগুলোতে প্রবেশের দরকার হতে পারে। তাই তারা অধিকাংশই শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় দরজা খোলা রেখে যেত।

ন্যাটোর চোখে পড়ার ভয়ে গাদ্দাফীর সঙ্গীরা একসাথে বেশি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করত না। বাসা পরিবর্তন করার সময় তারা একটি-দুইটি গাড়ি ব্যবহার করত। সেগুলোই প্রতিবার তিন-চারজনকে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে যেত বাকিদেরকে নেয়ার জন্য। এর মধ্যে প্রায়ই বিদ্রোহী সেনাদের মর্টার বা গ্র্যাড মিসাইল তাদের বাসায় আঘাত করত। তখন তাদেরকে আবার বাসা পরিবর্তন করতে হতো।

এরকম একটি আঘাতে একবার তাদের সাথে সাথে থাকা তিন প্রহরী আহত হয়েছিল। কিন্তু তাদের চিকিৎসা করার মতো কোনো ডাক্তার বা কোনো ওষুধপত্রও তাদের কাছে ছিল না। বিদ্রোহীদের মিসাইলে গাদ্দাফীদের বাবুর্চিও আহত হয়েছিল। ফলে দলের সবাইকে পর্যায়ক্রমে রান্নায় অংশগ্রহণ করতে হতো। গাদ্দাফী নিজে অবশ্য রান্না করতেন না, কিন্তু তিনি প্রায় সময়ই নিজের এবং অন্যদের জন্য চা তৈরি করতেন।

শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। গ্যাস সিলিন্ডারের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্তত তিন মাস ধরেই মানুষকে মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হতো। এ সময় বিদ্রোহীদের এলোপাথাড়ি গোলা নিক্ষেপে বাসার ছাদের উপরে থাকা পানির ট্যাংকগুলোও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। 

পানি, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে কাটাতে গাদ্দাফী ধীরে ধীরে অধৈর্য্য হয়ে উঠতে থাকেন। বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি প্রায়ই রেগে উঠতেন। মানসুর দাও জানান, তখন তারা তাকে সান্তনা দেয়ার জন্য তার পাশে গিয়ে বসলে গাদ্দাফী প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন এই বলে যে, কেন বিদ্যুৎ নেই? কেন পানি নেই?

মানসুর দাও জানান, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গাদ্দাফির চেহারায় কখনোই ভয়ের ছাপ দেখা যায়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত শান্ত ছিলেন। মৃত্যুর জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন, হয়তো সিরতে অথবা ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী যে গ্রামটিতে তার জন্ম হয়েছিল, সেই জারফে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। তবে গাদ্দাফি তার বন্ধু রাষ্ট্রনায়কদের উপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ ছিলেন। 

বিশেষ করে ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুস্কোনি, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগানের উপর তিনি প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। এদেরকে তিনি ব্যক্তিগত বন্ধু মনে করতেন, কিন্তু তার বিপদে এরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে তাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে শামিল হওয়ায় তিনি হতাশ ছিলেন।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে