এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : মাত্র একজন ডোনার কিভাবে নিজে বেঁচে দু’টি জীবন বাঁচালেন? কোনো ব্যাখ্যা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও মনে করেন, ঈশ্বরই পুরো ব্যাপারটা তদারকি করেছেন।
জুলি স্টিটের স্বামী ও বাবা উভয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন দরকার। কিন্তু দেয়ার মতো কিডনি আছে তার মাত্র একটি। তিনি কি পেরেছিলেন ওই দু’টি জীবন বাঁচাতে? রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে জবাবটি নেয়া হয়েছে।
দুই হাজার চার সালে মার্চের এক সুন্দর দিনে চাক স্টিট যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়ার লিটল প্যাটুক্সেন্ট নদীতে মাছ শিকারে নেমেছিলেন। তার হাতে ছিপ, বুটজোড়ার নিচ দিয়ে ঠান্ডা পানি বয়ে যাচ্ছে। টাউট মাছ টোপ গিলবে, তিনি সেই আশায় অপেক্ষা করছেন।
টাউট তার টোপ গেলার আগে তিনি নিজেই অঘটনের শিকার হলেন। কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি ছাড়াই তার চোখ দু’টিতে নিকষ অন্ধকার নেমে এলো।
ওই এলাকায় তখন চাক একাই ছিলেন। হঠা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলায় তার প্রভাব শরীরেও পড়ল, তিনি ভারসাম্য হারিয়ে নদীর মাঝখানে পড়ে গেলেন। তিনি কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতেও পারছিলেন না, মোবাইল ফোনটি ফেলে এসেছেন বাড়িতে। চাক ছিপ ফেলে দিলেন, আস্তে আস্তে পানি ভেঙে এগিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তার পায়ে তীর ঠেকল।
সামনে এখন পাথুরে ১০০ ফুট উঁচু পাহাড়, তার আর তার পিকআপ ট্রাকের মাঝে আধা মাইল কালো পাথরের প্রাচীর। তবে এলাকাটি ছিল ৫২ বছরের চাকের কাছে মুখস্ত। এই পাহাড় তাকে ডিঙাতে হবে। তবেই কারো তাকে দেখার সম্ভাবনা আছে। তিনি আস্তে আস্তে চলতে লাগলেন।
হাত বাড়িয়ে গাছের সাথে ধাক্কা এড়াতে লাগলেন। তিনি পারলেন তার ট্রাকের কাছে পৌঁছাতে। তিনি ভেতরে ঢুকলেন, ড্রাইভিং সিটেও বসলেন। কিন্তু চালাতে পারছিলেন না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার কেটে যেতে লাগল, দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে লাগলেন। গাড়ি চালানোর মতো দেখতে পেলেন। তিনি সোজা ডাক্তারের চেম্বারের পথ ধরলেন।
অবস্থার অবনতিই হলো : চাকের ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করালেন। দুই দিন পর ডাক্তার মহোদয় বিস্মিত হয়ে চাককে তাড়াতাড়ি ইআর করাতে বললেন। এই পরীক্ষায় দেখা গেল, ক্রিয়েটিনিনের (পেশি নাড়াচাড়ার ফলে সৃষ্ট উপজাতকের বর্জ্য) মাত্রা অত্যন্ত বেশি, অর্থাৎ তার দু’টি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে।
চাক বলেন, ‘আমি যখন কথাটা শুনলাম, মনে হলো মৃত্যু পরোয়ানা জারি হলো।’
তিনি হাওয়ার্ড কাউন্টি জেনারেল হাসপাতালের ইআরে ছুটে গেলেন। নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তাররা তার গলায় ক্যাথেটার লাগালেন, যাতে তিনি ডায়ালিসিস চিকিসা নিতে পারেন। সাধারণত ডায়ালিসিস চার ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু চাকের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। তার চিকিৎসায় সময় লাগল দেড় দিন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন চাক ও তার স্ত্রী জুলিকে বলল যে, চাক এখন কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য উপযুক্ত হয়েছেন, তখন জুলি সম্ভাব্য ম্যাচ হিসেবে পরীক্ষা করাতে চাইলেন। কিন্তু চাক রাজি হলেন না। তাদের তিন সন্তানের সর্বকনিষ্ঠটি এখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়ে, তিনি চাচ্ছিলেন, জুলি যেন সন্তানদের দিকেই নজর দেন।
হাতের কাছে কিডনি না পাওয়ায় চাক মেরিল্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিস্থাপন তালিকায় তার নাম তুললেন। তিনি ডোনারের অপেক্ষায় সপ্তাহে তিনবার করে ডায়ালিসিস চিকিসা নিতে লাগলেন।
নতুন কিডনি, নতুন সমস্যা : সাড়ে তিন বছর পর চাক অবশেষে প্রতিস্থাপনের কিডনি পেলেন। (কারো কারো কিডনি পেতে সাত বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।) সার্জারিটা সফল হলেও এর পরবর্তী পর্যায়টা ভালো ছিল না। প্রতিস্থাপিত কিডনি সামর্থ্যরে ৫০ ভাগের বেশি কার্যকর হলো না। এক বছর পর ফেল করতে শুরু করল। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় চাক হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আবার ডায়ালিসিস দেয়া শুরু হলো। আবারো জুলি সম্ভাব্য ডোনার হিসেবে পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। চাক আবারো তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
২০১১ সালে মৃত-ডোনারের কিডনি পাওয়া গেল চাকের দেহে লাগানোর জন্য। অতি সম্প্রতি মারা গেছে, এমন লোকদের কাছ থেকে এ ধরনের কিডনি সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত জীবিত, স্বাস্থ্যবান লোকদের কিডনি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কারণ সেগুলো কম প্রত্যাখ্যাত হয়, এগুলো টেকেও বেশি দিন। এবারো অপারেশন সফল হলো। কিন্তু চাকের দেহে কয়েক দিন পরই ইনফেকশন দেখা দিলো। জটিলতা বাড়ল হার্নিয়াসহ আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায়। এক দিন অপারেশনের স্থানে গভীর ক্ষত নিয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হলেন।
সময়ের পরিক্রমায় দ্বিতীয় প্রতিস্থাপনও ফেল করতে লাগল, এবার তিনি মত বদলালেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারো?’
জুলি নাম লেখালেন : জুলি পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারলেন, রক্তের গ্রুপ মিলছে না। তবে বিকল্প আছে। তিনি কিডনি বিনিময় কর্মসূচিতে নাম লেখালেন। এই কর্মসূচিতে দেশজুড়ে কিডনি ডোনারদের নাম তালিকাভুক্ত করে রাখে। একজন নির্দিষ্ট রক্তের কিডনি দেয়ার মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় গ্রুপের কিডনি সংগ্রহ করতে পারে।
জুলি অবশেষে সম্ভাব্য ডোনার পেলেন। তবে ওই লোকের পরিচয় জানতে পারলেন না। অপারেশন হলো। এবার আর কোনো ইনফেকশন বা প্রত্যাখ্যাত হলো না। কিডনিটা চমকারভাবে কাজ করতে লাগল।
না এই গল্পের শেষ এখানে নয়।
দুঃসংবাদ : চাক যখন সেরে উঠছিলেন, তখন তার শ্বশুর নিজস্ব সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। জুলির বাবা রিচার্ড কার্নের প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে ডায়াবেটিস ছিল। সেই ২৫ বছর বয়সে তার দেহে এই রোগ বাসা বেঁধেছিল। ২০১০ সালে ভয়াবহ হার্ট বাইপাস সার্জারির সময় তার কিডনি দু’টিই ফেল করে। তিনি ডায়ালিসিস নিতে শুরু করেন। ২০১২ সালের জুনে তার কিডনি দু’টি আবার ফেল করে। ডোনার না পাওয়ায় তিনি সম্ভাব্য দাতার অপেক্ষায় থাকলেন।
জুলি বলেন, ‘বাবা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারবেন, এমনটা ভরসা করতে পারছিলাম না।’ তিনি নিজে স্বামীর জন্য একটা কিডনি দিয়ে দেয়ায় (যদিও সেটি তখনো দেননি, যে রোগীর জন্য চাওয়া হয়েছিল, তিনি তখনো প্রস্তুত হননি) বাবাকে সাহায্য করতে পারছিলেন না। তিনি ও রিচার্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, জুলির কিডনিটি যাতে তার বাবার কাজে ব্যবহার করা যায়। অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলো।
এটাই স্বাভাবিক। তিনি স্বামীর জীবন বাঁচাতে যার কাছ থেকে কিডনি নিয়েছেন, তার আপনজনের প্রয়োজনও মেটানো দরকার। আইনগত কারণেই সব আবদার রাখা সম্ভব নয়।
রিচার্ড ২০১৩ সালের জুনে হাসপাতাল থেকে ফোন পেলেন যে একটি কিডনি পাওয়া গেছে, তবে সেটা যথাযথ হবে কি না তা নিশ্চিত নয়।
এক মাস পর রিচার্ড আরেকটি ফোন পেলেন। এবার যথাযথ কিডনি পাওয়া গেছে। জুলাইয়ে অপারেশনের তারিখ নির্ধারিত হলো। তবে দাতার নাম কেউ জানল না। হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে, দাতা আর গৃহীতার পরিচয় গোপন রাখা হয়। তবে অপারেশনের পর উভয় পক্ষ রাজি থাকলে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
ওই একই দিন জুলিও অস্ত্রোপচারের ডাক পেলেন। তবে একটু ভিন্ন সময়ে, একই হাসপাতালে হলেও অন্য তলায়। অপারেশনের দিন সকালে রিচার্ডকে ঘিরে ধরেছিলেন তার স্ত্রী ডোনা, চাক। সবাই ছিল উদ্বিগ্ন। কিন্তু একটু পর হঠাৎ করে ফিস ফিস করে আসা যে খবর তারা শুনলেন, তাতে তাদের চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। হাসপাতালের এক শ্রমিক বলছেন, তিনি ডোনারের রুমে যাচ্ছেন। তিনি রুমের নম্বরটিও দিলেন। সেটা ছিল জুলিরই নম্বর।
কী ঘটনা?
রিচার্ডের সার্জারি সফলভাবেই হলো। তার নতুন কিডনিও ভালোমতো কাজ করছে। এতে জুলির চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি। মেয়েরা কি সহজে বাবার জীবন দিতে পারে?
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে আমি আর কিছুই বলতে চাই না।’ তিনি স্বীকার করেন, তার বাবা তার কিডনি পেয়েছেন, এতেই তার সারা দেহমন আনন্দে ভরে গেছে। ‘আমি এর সাথে খারাপ কিছু মেশাতে চাই না। অলৌকিকভাবেই আমি আমার স্বামী ও বাবাকে সাহায্য করতে পেরেছি। এটা ছিল রহমতবিশেষ।’