এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : অদ্ভুত এক দেশ। যে দেশে রাজধানী নেই। নেই কোনো রাজনৈতিক দল। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। এক দিকে চীন অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি দ্বীপ। জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের অবস্থানও অনেক দূরে। তবে এ দেশগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে ছোট দেশ নাউরুতে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র দ্বীপদেশ। মাইক্রোনেশিয়া আর পলিনেশিয়ার জাতিগোত্রের মানুষ বসতি স্থাপন করেছে মাত্র আট বর্গমাইলের এ দেশটিতে। কোনো ঘোষিত রাজধানী নেই।
১৪টি বিভাগে ভাগ করে শাসনকাজ পরিচালনা করা হয়। বিচার আর প্রশাসনিক ইউনিটগুলো মূলত বিভাগীয় কেন্দ্রগুলোতে বিন্যস্ত করে দেয়া হয়েছে। দেশটিতে নেই কোনো আনুষ্ঠানিক রাজনৈতক দল। এখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। ১৮ সদস্যের সংসদে প্রতি তিন বছর অন্তর নির্বাচন হয়। ভোটাভুটির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের মধ্যে একজনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। রাজনৈতিক দল না থাকায় যে ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা, তা হয় না। এর প্রধান কারণ গোষ্ঠী আর আত্মীয়তা রাজনৈতিক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
সরকার গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে আত্মীয়তা। ১৩ হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে প্রভাবশালী মানুষগুলো একে অন্যের পরিচিত। নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। এ কারণে রাজনৈতিক দল গঠন ও বিকাশ হয়নি। তবে রাজনৈতিক দল যে একদম নেই এ কথা বলা যাবে না। যেমন সর্বশেষ নির্বাচনে ১৮টি আসনের সংসদের তিনজন রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত হন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, নাউরু ফার্স্ট ও সেন্টার পার্টি নামের তিনটি রাজনৈতিক দলের নাম পাওয়া যায়। তবে এগুলোর গঠন ও কার্যক্রম প্রচলিত রাজনৈতিক দলের মতো নয়। তাই এগুলোকে সেই অর্থে রাজনৈতিক দল বলা যাবে না।
কমপক্ষে ৩ হাজার বছর আগে মাইক্রোনেশিয়ান আর পলিনেশিয়ানরা নাউরুতে বসতি স্থাপন করে। তারা ১২টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এ জন্য দেশটির পতাকায় ১২টি তারকাখচিত। ব্রিটিশ ক্যাপটেন ও তিমি শিকারি জন ফেয়ার্ন প্রথম পশ্চিমা নাগরিক ১৭৯৮ সালে দেশটিতে আসেন। ১৮৩০-এর দশকে নাউরুর সাথে পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
এ সময় থেকে ইউরোপীয়রা নাউরুতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। উনিশ শতকে জার্মানরা নাউরুতে উপনিবেশ স্থাপন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এর দখল চলে যায় যৌথভাবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর যুক্তরজ্যের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশটি দখল করে নেয় জাপান। যুদ্ধের সময় নাউরুকে বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহার করে তারা।
১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে জাপানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। এরপর একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে দেশটি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে স্বায়ত্তশাসন পায় নাউরু। ১৯৬৮ সালে দেশটি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পায়।
১৯০০ সালে দেশটিতে ফসফেটের খনি আবিষ্কার হয়।
এক নজরে নাউরু

দেশের নাম : রিপাবলিক অব নাউরু
জনসংখ্যা : ১৩ হাজার
রাজধানী : কোনো রাজধানী নেই
আয়তন : ৮ বর্গমাইল
প্রধান ভাষা : নাউরুয়ান ও ইংরেজি
প্রধান ধর্ম : খ্রিষ্টান
মুদ্রা : অস্ট্রেলিয়ান ডলার
জার্মানদের একাধিপত্যের কারণে প্রাপ্ত লাভের অংশ পেত না স্থানীয়রা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এর দ্বারা এককভাবে লাভবান হয় জার্মানরা। পরে ফসফেটের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশ ফসফেট কমিশনের কাছে। ১৯৭০ সালে ফসফেট সম্পদ নাউরুদের দখলে আসে। তত দিনে ব্রিটিশরা মূল সম্পদকে শুষে নিয়েছে। এর একটা অংশের মালিকানার কারণে নাউরুর অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত উন্নত হয়। কিন্তু দেশটির কাঠামোগত কোনো উন্নতি হয়নি। নগদ টাকা দিয়ে তারা ভোগবিলাসে মত্ত ছিল।
চতুর ব্রিটিশরা দেশটির অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিবর্তে তাদের ভোগবিলাসী করে তোলে। ফলে ফসফেট রফতানি যেই বন্ধ হলো দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, অপরিকল্পিত ফসফেট উত্তোলনের ফলে দেশটিতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেখা দেয় অস্থিরতা।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে দেশে ১৭টি সরকারের পতন হয়। চলমান এ অস্থিরতা এখনো দেশটির উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। এখন নাউরু পুরোপুরি বিদেশী সাহায্যনির্ভর। এর বড় একটা অংশ আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। এ সাহায্যের বিনিময়ে তারা নাউরুকে ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করছে। এক চুক্তির মাধ্যমে নাউরু অস্ট্রেলিয়া গমনেচ্ছু অনুন্নত বিশ্বের সব নাগরিককে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলো থেকে অসংখ্য মানুষ অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া এসব মানুষকে সীমান্ত থেকে ধরে নাউরুতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নাউরুর বাজেট তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। নাউরুর আলাদা কোনো মুদ্রা নেই। তারা অস্ট্রেলিয়ান ডলার ব্যবহার করেন।
নাউরু জাতিসঙ্ঘ সদস্য। মজার বিষয় হলো ছোট এ দেশটি দারুণভাবে জাতিসফঙ্ঘর সদস্যপদের সুযোগটি ব্যবহার করছে। তারা চীন ও তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে দেশ দু’টি থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করছে। ২০০২ সালে তারা চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর মাধ্যমে তারা দেশটি থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য পায়। চুক্তির দুই দিন পর তাইওয়ানের সাথে নাউরুর সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে।
কয়েক দিন পর দেশ দু’টির মধ্যে আবারো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মূলত চীন ও তাইওয়ান ছোট এ দেশটির জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদপ্রাপ্তির সুযোগকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সমর্থনে কাজে লাগাতে চায়। ইতোমধ্যে নাউরু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে।
নাউরু নিরক্ষরেখার ২৬ মাইল দক্ষিণে ডিম্বাকৃতির ছোট দ্বীপ। এর আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র ১০ ভাগের ১ ভাগ। চার দিকে রয়েছে প্রবাল প্রাচীর। ভূমির গড়ন পাহাড়ি। উঁচনিচু এবড়ো-খেবড়ো। চার দিকে বালুময় সমুদ্র সৈকত। দ্বীপবাসীদের সুবিধার জন্য ১৬টি কৃত্রিম খাল খনন করা হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে সুপেয় পানি সংরক্ষণ সুবিধা সীমিত।
একটি মাত্র প্লান্ট রয়েছে সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করার জন্য। নাউরুর জলবায়ু উষ্ণ ও অতিমাত্রায় আর্দ্র। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ওঠানামা করে। এর ধরন একেক বছর একেক রকম। দিনের বেলায় তাপমাত্রা ২৬ থেকে ৩৫ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। রাতে তা ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি হয়। সমুদ্রের পানির উচ্চতা ওঠানামার কারণে দ্বীপবাসীর জীবন ও স্থাপনা সব সময় শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
ফসফেট রফতানির মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতি হঠাৎ করে ফুলে ফেঁপে ওঠে। খনিজাত সম্পদটি নিঃশেষ হওয়ার পর অর্থনীতিও ধপাস করে পড়ে যায়। মানুষ আবার নিমজ্জিত হয় আকণ্ঠ দরিদ্রতায়। এখন দেশটির অর্থনীতি সাহায্যনির্ভর। এ জন্য তাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় অস্ট্রেলিয়ার ওপর। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, হঠাৎ করে আসা ফসফেট বিক্রির আয় তাদের আয়েশী করে ফেলে।
নাউরুর মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে মোটাসোটা। ৯০ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রয়োজনাতিরিক্ত মোটা। দেশটিতে ডায়াবেটিসের হারও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মূত্রথলির সংক্রমণ এবং হৃদরোগের হারও এ দেশে অত্যন্ত বেশি।
জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশ নাউরুয়ান। ২৬ শতাংশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য দ্বীপের। চাইনিজ ও ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত রয়েছে যথাক্রমে ৮ শতাংশ করে। ইংরেজি ভাষার প্রচালন রয়েছে ব্যাপকভাবে। সরকারি ভাষা নাউরুয়ান। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাই বেশি।
মাত্র ১৩ হাজার জনসংখ্যার দেশটিতে ১২টি জাতি-উপজাতির বসবাস।
তবে দু’টি উপজাতি ২০ শতকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মূলত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে এখানে বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঘটে। জনসংখ্যা নেমে এসছিল মাত্র দেড় হাজারে। মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রচলিত সংস্কৃতির ছেদ হয় তখন। মানুষের জীবনাচরণে এখন স¤পূর্ণ পশ্চিমাদের অনুকরণ পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষাদীক্ষায় অনুন্নত রয়ে গেছে। নিজেদের কোনো সামরিক বাহিনীও নেই। নিরাপত্তার বিষয়গুলো অস্ট্রেলিয়াই দেখে। -উকিপিডিয়া
২৩ সেপ্টেম্বর.২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আল-আমিন/এএস