তুহিন সাইফুল : ১৯৭১ সাল। বুলেট,বারুদ আর রক্তের হোলি খেলায় এদেশে শুরু হয়েছে মুক্তির প্রসব বেদনা। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যার যার জায়গা থেকে সবাই গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। কেউ স্টেনগান হাতে রণাঙ্গনে, কেউ গান গেয়ে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ অন্ধকারে প্রতিবাদের লিফলেট বিলি করে অথবা ফুটবল খেলার মাঠে কেউ কেউ সুর তুলেছিল প্রতিশোধের শ্লোগানে।
কল্পনা করুন তো সেই যুদ্ধের দিনগুলিতে এমন একটা দৃশ্য যেখানে পরাধীন একটি দেশের লাল সবুজের কাল্পনিক পতাকা পতপত করে উড়ছে, আর সেই পতাকা হাতে নিয়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন একদল তরুণ। এদের হাতে বন্দুক নেই তবুও এরা মুক্তিযোদ্ধা। জার্সি, শর্টস আর পায়ে বুট পড়ে সারা ভারত জুড়ে তারা ফুটবল খেলে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। তখনো একটি দেশ হয়ে উঠেনি এমন একটি জনপদের পক্ষে।
আমি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা বলছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতের মাটিতে দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ১৬টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ১২টিতে জয়ী ও ২টিতে পরাজিত হয়। অবশ্য জয়-পরাজয়ের চেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি ফুটবল দলের এভাবে জনমত সৃষ্টি করা ছিল একটি বিরল ঘটনা। আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব সেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কয়েকজন মহান ফুটবলারের সাথে-
মহান অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু : বাংলাদেশের জন্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে ফুটবলের মহান শিল্পী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর নাম। যুদ্ধের সময় এই দেশটি সৃষ্টির যে প্রসব বেদনা শুরু হয়েছিল, তার প্রতিটা মুহূর্ত তিনিও বুকে ধারণ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ফুটবল মাঠে রচিত হয় গৌরবময় এক অধ্যায়। ২৪ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থানীয় দলের সঙ্গে প্রথম ফুটবল ম্যাচে অংশ নেয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এ ম্যাচ উপলক্ষে ভারতের পাশাপাশি স্বাধীন দেশের জন্য সংগ্রামরত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়া একটি দেশের এভাবে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা ছিল এক অভাবিত ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবলে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ফুটবল খেলেছেন তিনি জাতীয় দলের হয়ে। ১৯৭৫ সালে মোহামেডানকে নেতৃত্ব দিয়ে ঘরোয়া লিগে চ্যাম্পিয়ন করে প্রথম বিভাগে ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন তিনি। এর আগে জাকারিয়া পিন্টু ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথম অংশ নেন।
জাকারিয়া পিন্টু ১৯৭৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে জাকারিয়া পিন্টুর নাম একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। শুধু একজন নন্দিত ফুটবলার হিসেবেই নয়, এদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে স্মরিত হবে তাঁর নাম।
একজন যোদ্ধা ও ফুটবলার মেজর হাফিজ, বীর বিক্রম : জাতীয় ফুটবলে টপ ফর্মে থেকেও মেজর (অবঃ) হাফিজ তখন খেলা ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিয়ে ছিলেন হাতে। তিনি শুধু যুদ্ধই করেননি, যুদ্ধের ময়দানে অপরিসীম সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে তিনি সম্মানিত হয়েছেন ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে। সাহসী এই বীর খেলার মাঠেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন দেখিয়েছেন। একজন আক্রমণাত্মক স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমত ত্রাস। বলের ওপর ছিল তাঁর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ।
একজন নিভৃতচারী ফুটবলার অমলেশ সেন : নীরবে-নিভৃতে যে ফুটবলারটি খেলার মাঠে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি হলেন অমলেশ সেন। দূর শৈশবে সেই যে ফুটবলের প্রেমে জড়িয়েছিলেন, তার বন্ধন আজো কাটাতে পারেননি। ফুটবলই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন।
অমলেশ ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত খেলেন ফায়ার সার্ভিস এবং ইস্টএন্ডের হয়ে। ১৯৭০ সালে খেলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। অমলেশ সেনের জীবনের একটি গৌরবময় ঘটনা হলো ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলা।
১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ২১তম মারদেকা ফুটবলে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসেও তিনি দলভুক্ত হন।
ফুটবল ছাড়াও অমলেশ সেন ক্রিকেটও খেলেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বগুড়া একাদশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ফুটবল জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে পান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্কের যে রাখীবন্ধন গড়ে তোলেন অমলেশ সেন, তা সযত্নে সাধকের নিষ্ঠায় লালন করে এসেছেন।
পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলা গোলরক্ষক সান্টু : অসাধারণ পার্ফমেন্স দেখিয়ে পুর্ব বাংলার হাতেগোনা যে ক’জন ফুটবলার পাকিস্তান দলে খেলতে পেরেছেন, তাদের একজন গোলরক্ষক শহীদুর রহমান চৌধুরী সান্টু। দীর্ঘদেহী এই ফুটবলার ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা গোলরক্ষক।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সান্টুর অভিষেক হয় ১৯৬৭ সালে। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে আফগানিস্তানে খেলতে যান। জাতীয় দলে প্রথম খেলেন ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে তুরস্কের আরসিডি টুর্নামেন্টে খেলেন। আরসিডি ও ফ্রেন্ডশিপ কাপ ফুটবল খেলতে দু’বার ইরান সফর করেন। রাশিয়ায় খেলেছেন প্রদর্শনী ফুটবল। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে নেপালে খেলেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি হন দেশের এক নম্বর গোলরক্ষক।
২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন শহীদুর রহমান চৌধুরী সান্টু। সান্টু ফুটবল খেলা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তাঁর মতো আরেকজন গোলরক্ষকের আজো দেখা মেলেনি। বাংলাদেশের ফুটবলে তিনিই গোলরক্ষকের মডেল হয়ে আছেন।
মহানায়ক কাজী সালাউদ্দিন : বাংলাদেশে যেকোন ধরনের খেলায় তিনি ছিলেন মহানায়ক। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সে সময় তাঁর সমকক্ষ তো দূরে থাকুক, তাঁর কাছাকাছি কেউ ছিলেন না। খেলোয়াড়ি জীবনে কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল আর দু’গাল বেয়ে নেমে আসা চওড়া গোঁফের এই ফুটবলার আমাদেরকে দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকারের পায়ে বল আসা মাত্রই তিনি সরাসরি আক্রমনে চলে যেতেন। তাছাড়া মাঠে তাঁর উপস্থিতিই পাল্টে দিতো খেলার দৃশ্যপট। মেধাবী এই ফুটবলারের পায়ে যে ফুটবল-শিল্প ঝিলিক দিয়ে উঠতো, তাতে বুঝিয়ে দিতেন তিনিই মাঠের রাজা।
১৯৬৯ সালে ওয়ারীর হয়ে শুরু হয় তাঁর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ। অবাঙালি স্ট্রাইকারদের আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও ১৮টি গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে ১৯৭০ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব তাকে দলভুক্ত করে। এরপর আসে ১৯৭১। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে’ সালাউদ্দিন যোগ দেন তূর্য হাজরা নামে। গোষ্ঠপাল একাদশ নামে কোলকাতার মোহনবাগানের সঙ্গে খেলায় চমৎকার একটি গোলও করেন তিনি।
ঢাকা ফুটবল লীগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও সালাউদ্দিন তাঁর দ্যুতি ছড়িয়েছেন। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে তাঁর চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় যুব দলে খেলেন। ঢাকা বিভাগীয় যুব দলের হয়ে করাচিতে পাকিস্তান জাতীয় যুব ফুটবলে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর প্রতিটি জাতীয় দলে তিনি ছিলেন অপরিহার্য ফুটবলার। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় ১৯তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ টাইব্রেকারে ৫-৩ গোলে জয়ী হয়। খেলার নির্ধারিত সময় সালাউদ্দিনের গোলে ২-২ গোলে অমীমাংসিত ছিল। পরের ম্যাচেও সালাউদ্দিনের গোলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। এছাড়াও ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ায় ২১তম মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে অংশ নেয় বাংলাদেশ।
শুধু দেশে নয় কাজী সালাউদ্দিন আলো ছড়িয়েছেন দেশের বাইরেও। হংকংয়ের পেশাদার ফুটবল লীগে ক্যারোলিন হিল ক্লাবের পক্ষে খেলেছেন তিনি দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে। এটি শুধু সালাউদ্দিন নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৭৬ সালে ১২টি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হংকং লীগে তিনি ১৮টি খেলায় অংশ নেন এবং সেবার তার দল ক্যারোলিন হিল ক্লাব লীগে চতুর্থ হয়।
ফুটবলার হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ খ্যাতির শীর্ষে থাকলেও সে তুলনায় সালাউদ্দিন পুরস্কৃত হয়েছেন খুবই কম। সেরা ফুটবলার হিসেবে ১৯৭৯ সালে এবং সেরা কোচ হিসেবে ১৯৯২ সালে তাঁকে সম্মানিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। তবে সান্তনা এই যে, ১৯৯৬ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের রজতজয়ন্তি উপলক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে সেরা একাদশ নির্বাচন করে এবং ২০০৫ সালে যে ১০ জন ফুটবলারকে সম্মাননা প্রদান করে তাতেও সম্মানীত করা হয় কাজী সালাউদ্দিনকে।
স্মার্টনেস, স্কিল, স্ট্যামিনা, বডি ফিটনেস, শারীরিক গঠন ও নৈপুণ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছেন সবসময়। তাই ফুটবলে সহসা’ই একজন সালাউদ্দিনের দেখা মেলে না। সালাউদ্দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় যুগ যুগ ধরে।
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
১.উইকিপিডিয়া
২.সাংবাদিক দুলাল মাহমুদের বাংলা ব্লগ
৩.সামহোয়্যার ইন ব্লগ