বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:০৩:২৪

পুরনো ঢাকার যতো লোভনীয় খাবার

পুরনো ঢাকার যতো লোভনীয় খাবার

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ৪০০ বছরে পুরোনা এক শহর ঢাকা। বিভিন্ন সময়ে এখানে শাসন করে গেছেন বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকেরা। সমৃদ্ধ এই শহরকে কেবল বড় বড় সেনাপতিরাই আকর্ষণ করেনি বরং ব্যবসা কিংবা ধর্মপ্রচার করতেও এখানে এসেছেন বহু মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গা থেকে আসা এইসব মানুষেরা ঢাকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও এনেছে বিশেষ পরিবর্তন।

বাইরে থেকে আসা কিছু খাবার এখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে, তারপর ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে ঢাকার ঐতিহ্যে। শুধু ঢাকাবাসীই নন, ঢাকার বাইরের লোকেরাও ঢাকা এলে এসব খাবারের স্বাদ নেবার চেষ্টা করেন। এসব ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের আবার অদ্ভুত নামও রয়েছে, যেমন- জগা খিচুরি, বড় বাপের পোলায় খায়, পাগলার গেলাসী, খেতা পুরি, ইত্যাদি।

ঢাকার অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে- হাজির বিরিয়ানী, নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও, রয়েলের বোল পোলাও, নিরব হোটেলের নানান ভাজি-ভর্তা, বাকরখানি, আনন্দ বেকারী, চকবাজারের ইফতার সামগ্রী, নবাবপুরের সূতলী কাবাব, টানা পরোটা, বুন্দিয়া, নূরানী লাচ্ছি, বিউটি লাচ্ছি এবং লাবাং।

আসুন আজকে জেনে নিই এরকম কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কে-

বাকরখানি : মুঘল আমলের খাবারগুলো মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বাকরখানি রুটি। লোকমুখে প্রচিলত আছে আগা বাকেরের নাম অনুসারে এই রুটি তৈরী হয়েছে। এই রুটি আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পাওয়া যায়। প্রকৃত বাকরখানি খাঁটি ময়দা, ঘি, মাওয়ার খামির ও দুধ দিয়ে তৈরী করা হয়।

ঢাকা শহরে এখন বড় বড় রেষ্টুরেন্ট, চাইনীজ রেষ্টুরেন্ট এমনকি নামী-দামী ফাষ্ট ফুড দোকানে সয়লাব হয়ে গেছে, যেখানে বিত্তশালী লোকেরা সামান্য কিছু খাবারের পেছনে বিস্তর টাকা পয়সা খরচ করে। অথচ তারা কি কখনো এই সু-স্বাদু, মজাদার এবং মুখরোচক বাকরখানি রুটির কথা শুনেছেন, বাকরখানি রুটি কি, এর স্বাদই বা কেমন, দামই বা কত ইত্যাদি ইত্যাদি। কথার কোন ছল নয়, নয় লেখনীর কোন শব্দ আকর্ষন। একেবারে সহজ সাধা সিধে কথা।

কাচ্চি বিরিয়ানী : পুরনো ঢাকা মানেই যেন জিভে জল এসে যাওয়ার মতো সব খাবার-দাবার। স্বাদে, গন্ধে ও গুণগতমানে কোনটিই কোনটির চেয়ে কম নয়। এমন ধরনের একটি খাবার হচ্ছে কাচ্চি বিরিয়ানী। পুরনো ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, উর্দ্দু রোড, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, নবাবপুর, ইসলামপুর, ওয়ারী, মালিটোলা এবং মৌলভীবাজার এলাকায় কাচ্চি বিরিয়ানীর দোকানগুলো গড়ে উঠেছে। ভাল মান এবং ভাল স্বাদের জন্য কাজী আলাউদ্দিন রোডের হাজীর বিরিয়ানী, হানিফ বিরিয়ানী, মৌলভীবাজার রোডের নান্না মিয়ার বিরিয়ানী, উর্দ্দু রোডের রয়েল বিরিয়ানী, নারিন্দার ঝুনার কাচ্চি বিরিয়ানী, মালিটোলার ভুলুর বিরিয়ানী, নবাবপুরের ষ্টার হোটেলের কাচ্চি বিরিয়ানী, সুরিটোলার রহিম বিরিয়ানী এবং নাজিমুদ্দন রোডের মামুন বিরিয়ানী ঢাকায় বিখ্যাত। এখানে প্রস্তুতকৃত কাচ্চি বিরিয়ানির অতুলনীয় স্বাদ এবং গন্ধের কারনে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন ছুটে আসেন এই পুরনো ঢাকায়। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই সুস্বাদু কাচ্চি বিরিয়ানির সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।

লাবাং : এটি দুগ্ধজাতীয় পানীয়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে লাবাং অন্যতম। এই পানীয় সম্পর্কে যতদুর জানা যায় যে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশসমূহে প্রচলিত একটি পানীয়। সুস্বাদু এই পানীয় দেখতে দুধের মতো, স্বাদ ঝাঝালো, তবে বোরহানী নয়। বিশেষ করে চক বাজারে রমজান মাসে ইফতারিতে লাবাংয়ের নানা আয়োজন লক্ষ্য করা যায়।

পুরি : পুরনো ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে পুরি অন্যতম। ঢাকাবাসীর অন্যতম জনপ্রিয় খাবার এটি। পুরির রকমারি স্বাদ এবং বৈচিত্র্যময়তার কারণে এর জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। পুরি কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- আলু পুরি, ডাল পুরি, খ্যাতা পুরি এবং কিমা পুরি।

তেহারী : ভোজন রসিকদের মনে তেহারী একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পুরনো ঢাকার তেহারীর স্বাদ গ্রহন করেছেন, অথচ জিভে পানি আসি নি এমন লোক পাওয়া কঠিন। ১০০% খাঁটি না হলেও ভেজালমুক্ত খাবার বলা যায়। পোলাওয়ের চাল এবং মাংস (গরু/খাসি) এর প্রধান উপকরন। ঝোলমুক্তভাবে ছোট ছোট মাংসের টুকরো পোলাওয়ের চালের উপর ছড়িয়ে দিয়ে তেহারী রান্না করা হয়।

পুরনো ঢাকার ভাল মানের তেহারী পাওয়া যায় এমন কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট যেমন- রয়েল রেষ্টুরেন্ট, হাজীর বিরিয়ানী, নান্না মিয়ার বিরিয়ানী, ফকরুদ্দিন বিরিয়ানী, হানিফ বিরিয়ানী, মামুন বিরিয়ানী, তৃপ্তি বিরিয়ানী, তেহারী ঘর অন্যতম। এছাড়া ঢাকার চকবাজার এবং নীলক্ষত বই মার্কেটে ভাল তেহারী পাওয়া যায়।

শাহী মোরগ পোলাও : পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান নান্না মিয়ার বিরিয়ানী সুস্বাদু মোরগ পোলাওয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। ‘নান্না মিয়ার বিরিয়ানী’র প্রধান শাখাটি বেচারাম দেউরিতে অবস্থিত। শাখাটি ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দোকানের কর্ণধার হাজী নান্না মিয়া পুরনো ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা, ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে বিরিয়ানীর ব্যবসা আরম্ভ করেন। এখন তাঁর শুভানুধ্যায়ী, পরিবার, বন্ধু এবং আত্বীয়-স্বজনেরা হাল ধরেছেন।

জাফরান মিষ্টি : রসমালাই এবং জাফরান মিষ্টি দেখতে এক নয়। রসমালাইয়ে মিষ্টিগুলো ছোট ছোট, মিষ্টিগুলো স্রেফ মিষ্টি এবং মালাইরস মেশানো। কিন্তু জাফরান মিষ্টি আকারে এবং আয়তনে বেশ বড়। জাফরান মিষ্টির উপর শুধু মালাইয়ের রস ঢেলে দিয়ে তা মুখে দিতেই মনে হয় এই স্বাদ কখনো ভোলার নয়। জাফরান মিষ্টি বিশেষ ভাবে তৈরী যা মিষ্টির মতোই কিন্তু মুখরোচক। প্রবাদ আছে যে খাইলেই চাটবেন, না খাইলে পস্তাইবেন। হ্যা ঠিক তাই। জাফরান মিষ্টির স্বাদ অন্য যেকোন মিষ্টির স্বাদের তুলনায় যেন অতুলনীয় একটি স্বাদ।

কাবাব : পুরনো ঢাকা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বাহারি কাবাবের স্বাদে। এখানে উত্কৃষ্ট মানের শিক কাবাব, বটি কাবাব, খিড়ি কাবাব, সূতি কাবাব পাওয়া যায়। ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, নবাবপুর, জনসন রোড এলাকায় সুস্বাদু কাবাব পাওয়া যায়। রমজান মাসে প্রায় ৩০-৪০ পদের কাবাব এখানে তৈরী করা হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শর্মা কাবাব, ডোনা কাবাব, বিফ কিমা, বিফ জালি, মার্টন মুঠি, মার্টন চাপালি, খাসির আস্ত রানের কাবাব, হাড্ডি, আস্ত খাসির কাবাব, কোয়েল পাখির কাবাব, কবুতরের কাবাব, টিকিয়া, গ্রিল চিকেন, চিকেন টিকিয়া, অ্যারাবিয়ান, করমি, রেশমি, জালি, লাহরি, বটি, শামি, সূতি, মুরগী মোসল্লাম এবং ইরানী শিক। এছাড়া গোশতের কাবাবের পাশাপাশি মাছের কাবাব সমানভাবে জনপ্রিয়। ইলিশ, চিংড়ি, রুই- ইত্যাদি মাছের কাবাব এযুগের সংযোজন হলেও বহু পূর্বে পুরনো ঢাকায় মাছের কাবাব পাওয়া যেত।
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে