বৃহস্পতিবার, ০৫ মে, ২০১৬, ১০:১২:৩১

সেদিন লন্ডনের রাস্তায় বাংলাদেশি পোশাক কর্মী আলতাব আলীর সাথে কি ঘটেছিল?

সেদিন লন্ডনের রাস্তায় বাংলাদেশি পোশাক কর্মী আলতাব আলীর সাথে কি ঘটেছিল?

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ১৯৭৮ সালে পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলায় মারা যান বাংলাদেশি তরুণ আলতাব আলী। ১৯৭৮ সালের চৌঠা মে আলতাব আলীর মৃত্যু গোটা সম্প্রদায়কে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। আজকের দিনটি আলতাব আলী স্মৃতি দিবস হিসাবে স্মরণ করা হয়।

৩৮ বছর আগের সেই হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আলতাব আলীর বন্ধু শামসুদ্দিন বললেন, “আলতাব আলি যখন মারা গেলেন, তখন আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা রইল না। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের লড়াইয়ে নামতে হলো।”

“প্রতি বছর চৌঠা মে আমি তার জন্য দোয়া করি,” যেখানে ২৫ বছরের ওই তরুণকে ঘাড়ে ছুরি মারা হয়েছিল সেই জায়গাটা দেখিয়ে বিবিসির সাংবাদিক ক্যাটরিন নাই এবং স্যাম ব্রাইটকে বলেন শামসুদ্দিন।

যেখানে তাকে ছুরি মারা হয়েছিল তার কয়েক মিটার দূর পর্যন্ত কোনো মতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন আলতাব আলী। তারপরই রাস্তায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

যাদের সঙ্গে মিঃ আলির শেষ কথা হয় তাদের একজন মিঃ শামসুদ্দিন। তখন শামসুদ্দিন ছিলেন ১৮ বছরের তরুণ। একই রাস্তায় কাজ করতেন তারা- বন্ধু ছিলেন এবং প্রতি শনিবার একসঙ্গে বসে টেলিভিশনে কুস্তি দেখতেন।

ঘটনার দিন ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন। প্রথম ভোটাধিকার পেয়ে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন শামসুদ্দিন। কাজে শেষে বাড়ি ফিরছিলেন আলতাব আলী। হাতে ছিল তার বাজারের ব্যাগ।

“তিনি বললেন বাসায় যেতে হবে, রান্না করতে হবে। তারপর বেরবো – আমিও ভোট দিতে যাব।” কিন্তু সেসব করার সুযোগ আর তিনি পান নি। সেন্ট মেরিস্ পার্কে তাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।

১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে এসেছিলেন মিঃ আলী। তার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল তিন কিশোর- রয় আর্নল্ড, কার্ল লাডলো এবং আরেক কিশোর । আর্নল্ড আর লাডলোর বয়স ছিল ১৭। অন্যজন ছিল ১৬ বছরের কিশোর।

সেটি ছিল বর্ণবাদী হামলা। তারা আলতাব আলীকে চিনতো না। অন্য বর্ণের মানুষকে মারাই ছিল উদ্দেশ্য।

“কোনো কারণই ছিল না,” পুলিশকে জানিয়েছিল ১৬ বছরের কিশোর, যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন সে আলতাব আলীর ওপর হামলা চালিয়েছে।

বর্ণবাদীরা দক্ষিণ এশীয় লোকেদের ‘পাকি’ বলে গালি দিত। ওই কিশোর পুলিশকে তখন বলেছিল, আমরা পাকিদের দেখলে তাদের গালি দিতাম। তাদের কাছে অর্থ চাইতাম, তারপর তাদের মারধোর করতাম। আমি নিজেই অন্তত পাঁচবার পাকিদের মারধোর করেছি।

আলতাব আলীর মৃত্যু ছিল পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলার আরো একটা কালো অধ্যায়।

১৯৩৬ সালে জার্মানির নাৎসীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি বর্ণবাদী গোষ্ঠি ওই এলাকায় তখন বসবাসরত ইহুদীদের বিরুদ্ধে বিশাল মিছিল বের করার পরিকল্পনা নিয়েছিল।

তখন তিন লাখ এলাকাবাসীর প্রতিবাদ ওই মিছিল রুখে দেয়। ১৯৭৮ সালে আলতাব আলির মৃত্যুর পর পূর্ব লন্ডনের ওই এলাকা আবার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার হয়।

ওই এলাকায় ৭০এর দশকে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি অভিবাসী থাকতেন তাদের অনেকের মতই আলতাব আলী কারখানায় কাজ করতেন- আয়ের অর্থ দেশে পাঠাতেন পরিবারের জন্য। তার মৃত্যু সেখানকার মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল দিনবদলের জন্য সংগ্রাম ছাড়া পথ নেই।

জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশানাল ফ্রন্ট পৌরসভার ৪৩টি আসনের জন্য সেবছর প্রার্থী দিয়েছিল।

শামসুদ্দিন বলছেন অনেক বর্ণবাদী হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে, কিন্তু তারা একরকম চোখ ফিরিয়ে থাকতেন।

“আলতাব আলীর রক্ত আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল- আমরা বুঝতে পেরেছিলাম –চুপ করে থাকার দিন শেষ- এখনই মুখ না খুললে এরপর আর কার লাশ পড়বে কে জানে? ”

“আমাদের লড়াইয়ে বাংলাদেশিরা তো ছিলেনই, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যারিবীয়, ভারতীয়, পাকিস্তানি সবাই।”

১৯৭০ আর ৮০-র দশকের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকর্মী আনসার আহমেদউল্লাহ বলছেন বাঙালিদের জন্য সময়টা খুবই কঠিন ছিল।

“বাঙালিরা একা একা কোথাও যেতে পারতো না- তাদের প্রায়ই হেনস্তার শিকার হতে হতো। সরকারি ফ্ল্যাটবাড়িতে যারা থাকতো, তাদের প্রতিবেশিরা তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়েই দুর্ব্যবহার করত। তারা জানালার কাঁচ ভেঙে দিতো, লেটারবক্সের মধ্যে দিয়ে আবর্জনা ফেলে দিত- এককথায় জীবন দুর্বিষহ করে তুলত।”

শামসুদ্দিন বলছেন কারখানা এবং রেস্তোঁরায় যেসব বাংলাদেশি কাজ করতেন তারা ব্রিটেনের সমাজের অংশ হিসাবে নিজেদের দেখতে পারতেন না। তারা ছিলেন ব্রিটেনের সমাজ বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়।

মিঃ আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর প্রায় ৭ হাজার মানুষ তাঁর কফিন নিয়ে মিছিল করে যান লন্ডনের কেন্দ্রে। তারা লন্ডনের কেন্দ্রে হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ডাউনিং স্ট্রিটে কফিন মিছিল নিয়ে যান এবং পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদের অবসানের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানায়।

রাস্তার মিছিলে সামিল মানুষের কণ্ঠে ছিল শ্লোগান “কৃষ্ণাঙ্গ- শ্বেতাঙ্গ এক হও এবং লড়ো” – “ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট- ইউনাইট অ্যান্ড ফাইট।”

তবে পরিবর্তন সঙ্গে সঙ্গে আসে নি। ১৯৭৮এর জুন মাসে হ্যাকনি এলাকায় বর্ণবাদী হামলায় মারা যান আরেক ব্যক্তি ইশহাক আলি।

কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশানাল ফ্রন্ট তাদের সদর দপ্তর নিয়ে যায় পূর্ব লন্ডনে সেন্ট মেরিস পার্কের কাছে। এলাকায় উত্তেজনা বাড়ে।

মিঃ শামসুদ্দিন বলছেন বাংলাদেশিদের দিন কাটতে থাকে আতঙ্কে। তবে ন্যাশানাল ফ্রন্টের সদস্যদের বাধা দিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এলাকার বাংলাদেশিরা ও অন্যান্য বর্ণবাদ বিরোধীরা।

১৯৯০এর দশকে সহিংসতা কমে আসে এবং বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে পুলিশ ও সরকার বর্ণবাদ মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করে বলে বলছেন শামসুদ্দিন।

আলতাব আলীর মৃত্যু হয়েছিল যেখানে, পার্কের সেই জায়গায় ১৯৮৯ সালে আলতাব আলি এবং বর্ণবাদী হামলার শিকার সব মানুষের স্মৃতিতে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৮ সালে ওই পার্কের নামকরণ হয় আলতাব আলী পার্ক।
৫ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে