রবিবার, ০৮ মে, ২০১৬, ১২:০১:৪০

ইতিহাস গড়লেন সাদিক খান, নিউ কিং অব লন্ডন

ইতিহাস গড়লেন সাদিক খান, নিউ কিং অব লন্ডন

তাইসির মাহমুদ, লন্ডন থেকে : এ যেন রূপকথার গল্প। সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের এক সন্তান। উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় তার পিতা-মাতা পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখানেই জন্ম।

জীবনের শুরু থেকে উত্থান পর্যন্ত সংগ্রামের উপাখ্যান। পিতা ছিলেন বাসচালক। আর সংসার চালাতে সাহায্য করার জন্য মা করতেন সেলাইয়ের কাজ। জীবিকা নির্বাহ আর অধিকার আদায়ের লড়াইটা ছিল নিত্যদিনের। সেখান থেকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইতিহাস রচনা। বলছিলাম সাদিক খানের কথা।

লন্ডনের প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। গতকাল শপথ নিয়েছেন। আবেগাপ্লুত সাদিক খান উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘মাই নেম ইজ সাদিক খান। আই এম দ্যা মেয়র অব লন্ডন।’ শুধু বৃটেন কিংবা পিতৃভূমি পাকিস্তানেই নয়, বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে সাদিক খানের এই অর্জন। হবে নাইবা কেন। শুধু বৃটেন নয়, ইউরোপের যে কোনো রাজধানীর প্রথম মুসলিম মেয়র তিনি।

নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথের চেয়ে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫২৯ ভোট বেশি পেয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ১৩ লাখ ১০ হাজার ১৪৩। আর জ্যাক গোল্ডস্মিথ পেয়েছেন ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৬১৪ ভোট। সাদিক খান পেয়েছেন ৫৬.৮ শতাংশ ও জ্যাক গোল্ডস্মিথ পেয়েছেন ৪৩.২ শতাংশ ভোট। ৫৭ লাখ ৩৯ হাজার ১১ ভোটারের মধ্যে ৪৫.৬ শতাংশ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন মোট ১২ জন। ৫ই মে বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয় শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায়। সেন্ট্রাল লন্ডনের সিটি হলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে নির্বাচন কমিশনার আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করেন। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন নবনির্বাচিত মেয়র সাদিক খান ও পরাজিত মেয়র প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথ।

বিজয় বক্তৃতায় সাদিক খান বলেন, লন্ডন একটি গ্রেট সিটি। এই সিটির মেয়র হতে পেরে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। লন্ডনের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। দলমত নির্বিশেষে আমি এই সিটির সর্বস্তরের মানুষের মেয়র। আমি সবাইকে সমানভাবে সেবা করার চেষ্টা করবো। লন্ডনের মানুষ আমাকে তাদের আমানত দিয়ে বিজয়ী করেছেন। আমি সেই আমানত রক্ষায় সবকিছু করে যাবো।

তিনি বলেন, তার বাবা বেঁচে থাকলে আজ ছেলের বিজয় দেখে অনেক খুশি হতেন। অবশ্য মা বেঁচে আছেন। ছেলের বিজয়ে তিনি গর্বিত। এ সময় সিটি হলের গ্যালারিতে তার স্ত্রী সাদিয়া খান ও দুই কন্যা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচনে কঠোর পরিশ্রমের জন্য তার পরিবার ও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি এই সিটির মেয়র হবো। যা কল্পনায় ছিল না তা বাস্তব হয়েছে।

তিনি হাউজিং সমস্যা সমাধানসহ অন্যান্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করবেন বলে ঘোষণা দেন। জ্যাক গোল্ডস্মিথ তার বক্তব্যে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং সাদিক খানকে অভিনন্দন জানান। উল্লেখ্য, ৫ই মে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লন্ডনের ৩২টি কাউন্সিল নিয়ে গঠিত লন্ডন সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১০টার পরে শুরু হয় ভোট গণনা। আর চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ২৬ ঘণ্টা পরে। তাই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষা।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সিটি হল সাংবাদিকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। সিটি হলের নবমতলায় ছিল মিডিয়া রুম। রাতে ফলাফল ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত ছিল মূলধারার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ভিড়। অবশেষে রাত সাড়ে ১২টায় চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে কোলাহল ভাঙে সিটি হলেন। ফলাফল ঘোষণার পর সাদিক খান সিটি হলের কাছে একটি পাবে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক তাৎক্ষণিক বিজয় সমাবেশে মিলিত হন।

এ সময় তিনি লেবার পার্টির নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাদিক খান নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে মেয়র নির্বাচিত হলেও আগামী দিনগুলো তার জন্য যে কঠিন হবে তা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিলো। এর মূল কারণ তিনি প্রথমত মুসলিম, দ্বিতীয় ইমিগ্র্যান্ট। তাছাড়া, দলের লিডার জেরেমি করবিনের ওপর বেজায় নাখোশ অধিকাংশ মিডিয়া।

জেরেমি করবিনকে যেভাবেই হোক লিডারশিপ থেকে নামানোর চেষ্টায় তৎপর ডানপন্থি মিডিয়া। তাই মিডিয়া চায়নি সাদিক খান নির্বাচিত হয়ে লেবারের নেতৃত্ব আরো শক্তিশালী করবেন। এ জন্য জেরেমি করবিনকে সাদিক খানের কোনো ক্যাম্পেইনে একসঙ্গে দেখা যায়নি। গত মার্চে বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে সাদিক খানের জন্য ক্যাম্পেইনে এসেছিলেন জেরেমি করবিন। এসময় সাদিক খান তার সঙ্গে ছিলেন না। এমনকি স্থানীয় এমপি রুশনারা আলীও দলের লিডারের এই ক্যাম্পেইনে অনুপস্থিত ছিলেন।

শুক্রবার রাতে ফলাফল ঘোষণার আগে সিটি হলের পার্শ্ববর্তী পাবে লেবার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হন লিডার জেরেমি করবিন। এসময়ও সাদিক খান সেখানে ছিলেন না। তাছাড়া, বিজয়ের পর অনুষ্ঠিত তাৎক্ষণিক বিজয় সভায়ও অংশগ্রহণ করেননি জেরেমি করবিন। মিডিয়ার আক্রমণ থেকে বাঁচতেই তারা এ কৌশল অবলম্বন করছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হলেও বিবিসিসহ অধিকাংশ মিডিয়া সাদিক খান মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন-এমন সংবাদ আগে থেকেই প্রচার করছিলো। তবে একজন মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বলেই অতিমাত্রায় প্রচারণা চালাতে লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো পত্রিকা হেডলাইন করেছে ‘সাদিক ইজ নিউ কিং অব লন্ডন’।

বিবিসি মেয়র নির্বাচনী ফলাফলকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং স্কটিশ পার্লামেন্ট ও অন্যান্য কাউন্সিল নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কিছু কিছু মিডিয়া ইতিমধ্যে সাদিক খান চরমপন্থি সমর্থক মেয়র বলে অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছে। তাই সাদিক খানের আগামীর পথচলা মসৃণ হবে না বলেই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ্য, নির্বাচনে প্রথম ধাপে সাদিক খান পান ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৭১৬ ভোট। আর জ্যাক গোল্ডস্মিথ পান ৯ লাখ ৯ হাজার ৭৫৫ ভোট। সাদিক খান ৪৪.২ শতাংশ। জ্যাক গোল্ডস্মিথ ৩৫ শতাংশ। কিন্তু কেউই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় ধাপের ভোট গণনা শুরু হয়। দ্বিতীয় ধাপের ভোটে সাদিক খান পান ১ লাখ ৬১ হাজার ৪২৭ ভোট। আর জ্যাক গোল্ডস্মিথ পান ৮৪ হাজার ৮৫০ ভোট। প্রথম ধাপ ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে সাদিক খানের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা হয় ১৩ লাখ ১০ হাজার ১৪৩। আর জ্যাকের মোট ভোটসংখ্যা হয় ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৬১৪ ভোট। ২০১২ সালের মেয়র নির্বাচনে বর্তমান কনজারভেটিভ মেয়র বরিস জনসন ১০ লাখ ৫৪ হাজার ৮১১ ভোট পেয়ে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন। আর লেবারের প্রার্থী সাবেক মেয়র কেন লিভিংস্টন পেয়েছিলেন ৯ লাখ ৯২ হাজার ২৭৩ ভোট।

তার পিতা মাতা পাকিস্তান থেকে লন্ডন আসার পর ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন সাদিক খান। ৭ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে ৫ম ছিলেন তিনি। দক্ষিণ লন্ডনে দরিদ্রদের জন্য তৈরি কাউন্সিল ফ্ল্যাটে থেকে বড় হয়েছেন। সাদিক খান প্রায়ই স্মৃতিচারণ করেন, কিভাবে লন্ডনের বিখ্যাত লাস বাস চালাতেন তার পিতা। সেলাইয়ের কাজ করতেন মা। স্কুলে থাকাকালীন বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। হতে চেয়েছিলেন ডেন্টিস্ট। একজন শিক্ষকের নজরে পড়ে সাদিক খানের বাগ্মিতার প্রতিভা। তিনিই আইন বিষয়ে পড়ার জন্য সাদিককে দিকনির্দেশনা দেন।

ইউনিভার্সিটি অব নর্থ লন্ডন থেকে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্রিশ্চিয়ান ফিশার লিগ্যাল ফার্টে শিক্ষানবীস আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার পার্টনার হিসেবে পদন্নোতি অর্জন করেন তিনি। আইনি পেশায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতেন সাদিক খান।  ১৫ বছর বয়সে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন। এখনও একই এলকায় আইনজীবী স্ত্রী সাদিয়া ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন সাদিক খান। -এমজমিন
০৮ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে