চট্টগ্রাম : পার্বত্য জেলা বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র স্বর্ণমন্দির। জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে বালাঘাটের পুরপাড়ায় সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় এ মন্দির।
বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর অবকাঠামোগত সৌন্দর্যে মুগ্ধ পর্যটকরা। দেশ-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বৌদ্ধদের এ তীর্থ স্থানটি। কী হচ্ছে স্বর্ণ মন্দিরে? পর্যটক প্রবেশ নিষেধে রহস্য কি এমন প্রশ্ন জনমনে!
গত ২৩ জুন ১০/১২ জনের একদল পর্যটক গিয়েছিলেন সেই মন্দির দেখতে। তাদের জানা ছিল না যে, মন্দিরটি গত ফেব্রুয়ারি থেকে কর্তৃপক্ষের আদেশে বন্ধ রয়েছে।
মন্দির দেখতে গিয়ে মহাবিপাকে পড়েন পর্যটক দল। উদ্বেগের বিষয় হলো- মন্দির দেখার অনুরোধ করা হলে একপর্যায়ে দলবল নিয়ে মারতে ছুটে আসে ছোট্ট ছোট্ট শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে লেলিয়ে দেয়া হয় কয়েকটি পোষা কুকুরকেও। তাদের নেতৃত্বে ছিল এক ভান্তে। শিশুরাও কিন্তু ওই মন্দিরেরই শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, মন্দির থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। নোটিস ঝুলানো হয়েছে ‘সব দর্শনার্থীর প্রবেশে নিষেধ’।
২০ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বর্ণজাদী বন্ধ রাখা হয়েছে। ২৩ জুন দুপুর দুইটার দিকে দুটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় মন্দির এলাকায়। দুটি গাড়ি থেকে এক এক করে ১০ জন পর্যটক বেরিয়ে আসেন। তারা সবাই বাংলাদেশি।
তারা প্রথম স্বর্ণজাদীতে ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় ১৬-১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। পর্যটকরা মন্দিরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চান। এতে আরো ক্ষেপে যায় ওই কিশোর।
সেখানকার একটি ছবি ওঠানো হলে পর্যটক দলকে ইংরেজিতে গালাগাল শুরু করে সে। একপর্যায়ে উপজাতি কিশোরটি মোবাইল কল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে ২০-২৫ জনের একদল শিশু।
তাদের হাতে ছিল লাঠি, বাঁশের কঞ্চি, ক্রিকেটের ব্যাট-স্ট্যাম্প ইত্যাদি। আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। সঙ্গে তেড়ে আসে কয়েকটি পোষা কুকুর। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। শিশুরা তাদের নিজস্ব ভাষায় পর্যটকদের গালাগাল করে।
কিছুক্ষণ পর মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে একজন সন্ন্যাসী। তিনি পর্যটকদের কোনো কথা না শুনেই তাদের চলে যেতে বললেন। শুধু বললেন, ‘আপনারা এসেছেন কেন? চলে যান।’
পর্যটকরা বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন, তারা ঢাকা থেকে এসেছেন; মন্দিরটি দেখার অনেক ইচ্ছা। কোনো কথা না শুনে ওই ভান্তেও দুর্ব্যবহার শুরু করেন।
এ সময় উপস্থিত স্থানীয় বাঙালি দোকানদার বলেন, বেশি কথা বললে মারধরই শুরু করে দেবে। আপনারা চলে যান। শেষপর্যন্ত পর্যটকরা চলে যেতে বাধ্য হন। এভাবেই শত শত পর্যটককে ফিরে যেতে হচ্ছে স্বর্ণজাদী না দেখেই।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দর্শণার্থীদের কাছ থেকে প্রবেশ ফি হিসেবে দৈনিক কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা পেত সরকার, যা সরকারের কোষাগারে জমা হতো। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। মন্দিরের আশপাশের অন্তত শ’খানেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, মন্দিরের ভেতরে কী হয় সেটা এখন রীতিমতো রহস্য। এখানে সরকারি কোনো কর্মকর্তাও ঢুকতে পারেন না। কেন সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেয়া হয় না এ নিয়ে নানা প্রশ্ন।
একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সম্প্রতি ওই মন্দির পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রতিবেশি দেশের পাঁচ গোয়েন্দা। তারা ভান্তে বেশে এসে গোপন বৈঠক করে চলে যান। বিষয়টি নজরে এসেছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
বান্দরবান জেলার অতিরিক্ত প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবু জাফর গণমাধ্যমকে বলেন, মন্দিরের দেখাশোনা করেন সন্ন্যাসীরাই। তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা বলে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এটি কবে নাগাদ খোলা হতে পারে তা জানেন না তিনি।
১৯৯৫ সালে শ্রীমং উপজ্ঞা জোত মহাথের এই মন্দির স্থাপন করেন। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৪ সালে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। সম্পন্ন হয় ২০০৪ সালে। ১৮০টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এই মন্দিরে।
মিয়ানমার থেকে নির্মাণশিল্পী এনে এ মন্দিরের মূল নির্মাণকাজ করা হয়। মন্দিরের অঙ্গসজ্জা মেরুন আর সোনালি রঙের হওয়াতে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পুরো মন্দিরটিই স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো। বাহ্যিক রূপ থেকেই হয়তো মন্দিরটি ‘স্বর্ণ মন্দির’ নামে খ্যাতি পেয়েছে।
এ মন্দিরের পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এক পুকুর। বৌদ্ধরা এ পুকুরকে সম্মানের চোখে দেখে। এটিকে দেবতা পুকুর হিসেবেও জানে তারা।
মন্দিরটি যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়, তখন পবিত্রতা ও নিরাপত্তার অজুহাত আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কিছু পর্যটক ঢুকে মন্দির অপবিত্র করছে। পর্যটকরা মন্দির প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেককে হয়রানি করার কারণে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এদিকে ২৩ জুন স্বর্ণ মন্দির খুলে দেয়ার দাবিতে বন্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে প্রায় কয়েকশ’ মানুষ। তারা এ স্থানটি পুনরায় খুলে দেয়ার দাবি জানান।
১২জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম