ফরিদপুর : মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে বন্যা ও খরার কারণে দেশে খাদ্যের খুব অভাব দেখা দেয়। সেই অভাবের সময় চাচা মোমিন শেখের হাত ধরে মায়ের হাতের সেলাই করা হাফপ্যান্ট ও ছেঁড়া একটি শার্ট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ১১ বছরের কিশোর ইদ্রিস আলী। এরপর গ্রাম্য এক সরল কিশোরের জীবনসংগ্রামের শেষপর্যায়ে দীর্ঘ ৪৬ বছর পর গত শুক্রবার ফরিদপুরের সালথায় বাড়ি ফিরলেন ৫৭ বছরের ইদ্রিস আলী।
বাড়ি ফিরে পেলেন না গর্ভধারিণী মা কালাবুড়িকে। বাবা গোপাল শেখও বেঁচে নেই। আছেন শুধু এক বড় ভাই আবু তালেব। দুই ভাইয়ের মহামিলনে কাঁদলেন দুজনেই। এ দৃশ্য দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। এখন প্রতিদিনই ইদ্রিস শেখকে বহু মানুষ দেখতে আসে দূর-দূরান্ত থেকে।
৪৬ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে সেই সময়ের ১১ বছরের কিশোর ইদ্রিস আলী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পরে দ্যাশ-গ্রামে খবু অভাবের দিন পড়ে। তাই মা ও ভাইকে রেখে আমি চাচা মোমিন শেখের সাথে বাড়ি থেকে বের হই। চাচা তার পরিবারকে নিয়ে দিনাজপুর যাওয়ার পথে কুষ্টিয়া রেলস্টেশনের পাশে একটি খাবার হোটেলে আমাকে পেটে-ভাতে রেখে যায়। কয়েক দিন পরেই হোটেলটি ভেঙে দেওয়া হয়। তখন যে যেদিকে পারে, যার যার মতো চলে যায়। আমি তখন একা পড়ি। একদিন কাঁদতে কাঁদতে আমি রেলগাড়িতে চড়ে একটি শহরে চলে যাই। শহরের মোমিনপুর রেলস্টেশনে নেমে ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে থাকি। এ সময় একটি লোক এসে বলে, ‘বাবু তোমার বাড়ি কোথায়, তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?’ তখন আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে একটি হোটেল থেকে রুটি খাওয়ান। খাওয়া শেষে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। পরে জানতে পারি, আমি কুষ্টিয়া জেলার কোতোয়ালি থানার মোমিনপুর ইউনিয়নের কবিখালী গ্রামে মন্টু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছি।”
ইদ্রিস আলী বলেন, ‘কয়েক দিন পর মন্টু মিয়া আমাকে তাঁর বাড়ির পাশে মাহতাব উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়িতে রাখালের কাজ ঠিক করে দেন। এভাবে অনেক কষ্টের মাঝে চলতে থাকে আমার জীবন। প্রতি রাতে মা ও ভাইয়ের জন্য কাঁদি। কিন্তু পুরো ঠিকানা না জানায় কাউকে বাড়ির কথা বলতে পারি না। তার পরও আমার বাবা, ভাই, বটরকান্দা গ্রাম ও তার আশপাশের রামকান্তপুর, চাউলিয়া, বিভাগদী গ্রামের কথা বলে তাদের খোঁজ নিতে বলি। কিন্তু জেলা ও থানার নাম বলতে না পারায় কেউ সন্ধান বের করে দিতে পারে নাই। এক এক করে দিন, বছর যায়। এভাবে মাহতাব উদ্দীনের বাড়িতে আট বছর রাখালের কাজ করি। এরপর একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবীরের বাড়িতে সামান্য বেতনে প্রায় পাঁচ বছর থাকি। এরপর আব্দুল মান্নানের বাড়িতে এক বছর কৃষিকাজ করি। এর মধ্যে একই গ্রামের ডোরন মণ্ডলের মেয়ে জহুরা আক্তারকে আমার সাথে বিবাহ দেন মান্নান ভাই। বিবাহের পর অন্যর জমিতে কৃষিকাজ করে চলে আমার সংসার। আর মাঝে মাঝে মা ও ভাইকে পাওয়ার জন্য অনেক লোককে বলি।’
ইদ্রিস বলেন, ‘অবশেষে আব্দুল মান্নানের ভাতিজা গাজীপুরের পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তা শিলন মিয়া কানইপুর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সহযোগিতায় আমার ঠিকানা খুঁজে পান। এরপর নকুলহাটির মনিয়ার ও বটরকান্দার মুন্নু মাতুব্বারের মাধ্যমে বাড়িতে ফিরেছি। আমার বড় ভাইকে পেয়েছি। কিন্তু আমার মাকে পাইনি। জীবন কেন এত দুঃখ দিল আমায়?’
ইদ্রিসের আশ্রয়দাতা কুষ্টিয়া জেলা সদরের মোমিনপুর ইউনিয়নের কবিখালী গ্রামের আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ইদ্রিস আলী একজন সাদাসিধে মনের মানুষ। ১০-১১ বছর বয়সে আমাদের গ্রামে থেকে বড় হয়েছে। বিয়ের বয়স হলেও ওর সাথে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল না। কারণ ইদ্রিসের কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর, হিন্দু না মুসলমান, তাও কেউ জানে না। শুধু তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে আমার গ্রামের ডোরন মণ্ডলের মেয়ে জহুরা আক্তারকে বিয়ে দিই ওর সাথে। তারপর আমার জায়গায় একটি ঘর তুলে দিই থাকার জন্য। এখন দুটি মেয়ে নিয়ে ইদ্রিসের সংসার। এর ফাঁকে বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে থাকি আমরা সকলে। বছরখানেক ধরে আমার এক ভাতিজা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসার শিলন মিয়া বটরকান্দা, রামকান্তপুর, বিভাগদী নামের গ্রামগুলো কোন জেলায় তা খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে ফরিদপুর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের মাধ্যমে আমরা ইদ্রিস আলীর গ্রামের ঠিকানা খুঁজে পাই। তারপর আমরা ওকে বটরকান্দা গ্রামে নিয়ে যাই।’