নিউজ ডেস্ক : অষ্টম শ্রেণির ছাত্র পারভেজ সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। রাতে সে আর বাসায় ফেরেনি। পরদিন সকালে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসমান অবস্থায় পারভেজের লাশ খুঁজে পায় পুলিশ। পারভেজের মাথার ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। পুলিশ নিশ্চিত তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ জানতে পারে, অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত এ কিশোরটির সঙ্গে এলাকা বা তার স্কুলে কারোর কোনো শত্রুতা ছিল না। তবে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করল কে? এমন প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে পুলিশ পারভেজ খুনের তদন্ত শুরু করে। ঘটনাটি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মরিচারচর নামাপাড়া এলাকার। ঘটেছে গত বছর অক্টোবরে।
পারভেজের বাবা মুঞ্জুরুল হক মালয়েশিয়া প্রবাসী। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকেন স্ত্রী রোজিনা। পারভেজ ছিল তাদের বড় সন্তান। সে মরিচারচর উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। পারভেজের লাশ উদ্ধারের পর গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘটনার সময় পারভেজের সঙ্গে মোবাইল ফোন ছিল। সেটিও খোয়া গেছে।
থানা পুলিশ, সিআইডি, র্যাব এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পৃথকভাবে নিজেদের মতো করে তদন্ত শুরু করে। পারভেজের খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোনকে সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। পিবিআই সেই সূত্র ধরে অভিযান চালায় গাজীপুরের টঙ্গীতে। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় রবিউল ইসলাম নামে এক যুবককে। পুলিশ তাকে জেরা করলে সে একজন সাধারণ নিরীহ বলে দাবি করে। তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো জিডি বা মামলাও নেই বলে জানায়। পুলিশ তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন দেখিয়ে বলে, ওটার মালিক কে? রবি বুঝে যায়, সে ধরা পড়ে গেছে। রবিউল ইসলাম স্বীকার করে, ব্রহ্মপুত্র নদে উদ্ধার হওয়া পারভেজের খুনি সে নিজেই। কেন পারভেজকে সে খুন করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রবিউল যা বলল, তাতে কিছুক্ষণের জন্য হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গিয়েছিল পুলিশ দলের। রবিউল বলেছে, খুনের জন্য তাকে ৫০ হাজার টাকায় ভাড়া করেছিল পারভেজের মা নিজেই। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে সে ১৬৪ ধারায় দায় স্বীকার করে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। পুলিশ দ্রুত ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করে পারভেজের মা রোজিনা ইয়াসমীনকে।
পারভেজের বাবা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় পারভেজের মা রোজিনা জড়িয়ে পড়েন একাধিক পরকীয়ায়। রোজিনা দিন-রাত কথা বলতেন তার প্রেমিকদের সঙ্গে। বড় ছেলে পারভেজ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নানাভাবে তার মাকে বাধা দিত। তার মা যে নম্বরগুলোয় কথা বললেন পারভেজ কৌশলে সেই নম্বরগুলো ব্লক লিস্টে রেখে দিত।
রবিউলের বাড়ি পারভেজের বাড়ির কাছেই। পারভেজের মা রোজিনা তার ফোনের ব্লক করা নম্বরগুলো রবিউলের কাছ থেকে আনব্লক করে নিতেন। রোজিনা ফোনে কথা বলার জন্য মোবাইলে টাকা রিচার্জ করে নিতেন রবিউলের মাধ্যমে। পারভেজ দিন দিন আরও জোরালোভাবে তার মায়ের পরকীয়ায় বাধা দিতে থাকে। তার মাকে ভয় দেখায় সব ঘটনা সে তার বাবাকে বলে দেবে। ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন পারভেজের মা। পরিকল্পনা করতে থাকেন নিজ সন্তানকে হত্যা করে পথের কাটা দূর করার। এ দিকে রবিউল ইসলাম রবি টঙ্গীতে গিয়ে গার্মেন্টে চাকরি নেয়। ছেলেকে হত্যা করে পথের কাটা দূর করার পরিকল্পনা মোতাবেক পারভেজের মা রোজিনা ফোন করে রবিউলকে জরুরি কথা আছে বলে টঙ্গী থেকে বাড়িতে আনেন। রোজিনা ছেলে পারভেজকে খুন করার প্রস্তাব দেন রবিউলকে। বিনিময়ে অফার দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। লোভে পড়ে যায় রবিউল। অনেক চিন্তার পর রাজি হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে কীভাবে? তখন পারভেজের মা বলেন, তুমি নদীর পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা কর, আমি পারভেজকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তখন রবিউল নদীর পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সে নদীর পাড়ে থাকা একটি গাছের মোটা ডাল তার কাছে রাখে।
এদিকে রোজিনা তার ফোনটা পারভেজের হাতে দিয়ে বলে নদীর পাড়ে রবিউল আছে তুমি গিয়ে এই ফোনটা তাকে দিয়ে আস। পারভেজ তার সাইকেল নিয়ে নদীর পাড়ের উদ্দেশে বের হয়। মায়ের কথায় সরল বিশ্বাসে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে পারভেজ। পারভেজ নদীর পাড়ে পৌঁছে রবিউলকে দেখতে পায় এবং তার মায়ের দেওয়া ফোনটা রবিউলকে দিয়ে দেয়। ফোন রবিউলের হাতে দিয়ে পারভেজ বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রবিউল তার কাছে রাখা গাছের মোটা ডাল দিয়ে পারভেজের মাথায় সজোরে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। আকস্মিক আঘাতে হতবিহ্বল পারভেজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
রবিউল পারভেজের স্মার্ট ফোন এবং পারভেজের মায়ের দেওয়া বাটন ফোন দুটি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। রবিউল পারভেজের মায়ের কাছে গিয়ে হত্যার ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। তখন পারভেজের মা তাকে বলেন, এখন তুমি যাও। পারভেজের বাবা বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে আমি তোমাকে ডেকে দিয়ে দেব। রবিউল ওই রাতেই আবারও টঙ্গীতে ফিরে আত্মগোপন করে। পরদিন সকালে একই গ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পারভেজের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।